: শুক্কুরবার কেন? ওটা তো মুসলমানদের জুম্মাবার। তবে কি আউলচাঁদের সঙ্গে মুসলমান বা ফকিরিধর্মের কোনও যোগ ছিল?
রয়েল ফকির বললে, ‘আজ্ঞে সে সব গুহ্যকথা আমার গোঁসাই আমারে বলেন নি কিছু। তবে লালশশীর গানে যা বলেছে তা গাইতে পারি। শুনুন—
তার হুকুম আছে শুক্রবারে সৃষ্টির উৎপত্তি
সেই দিনেতে সবে হাজির হবে
যে দেশেতে আছে যার বসতি।
আছে যে দেশেতে যে মানুষ সবে হাজির হন
পরস্পর সেই অষ্টপ্রহর পরেতে স্ব স্ব স্থানে যান।
এই শুক্রবারে প্রহর রাত্রে লয়ে আশীর্বাদ।
যার মনে যা বাঞ্ছা আছে পূর্ণ হয় সে সাধ।
রয়েল ফকিরের সঙ্গে আমার যখন এ সব কথা হয় তখনও বিখ্যাত লেখক কমলকুমার মজুমদার বেঁচে ছিলেন। কে না জানে এ দেশের নানা বিদ্যা ও দেশজ সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। প্রথমবার ঘোষপাড়ার মেলায় যাবার আগে তাই কমলকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: ঘোষপাড়ার মেলা সম্পর্কে কিছু জানেন? আমি সামনের পূর্ণিমায় সেখানে যাব।
কমলকুমার প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপরে নাক কুঁচকে বললেন, ‘সে তো এক অসভ্য জায়গা মশাই। যাবেন না। শেষকালে কি এক বিপদ আপদে পড়বেন।’
তাঁর কথায় অবাক লেগেছিল। কথা হচ্ছিল এক প্রকাশকের ঘরে বসে। এক গবেষক ফস করে তাক থেকে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ খুলে কয়েক জায়গা পড়ালেন। দেখা গেল সহজিয়া এই প্রকৃতিভজা ধর্মের প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণ নানা বিদ্বেষ প্রকাশ করে গেছেন। আবার শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বই থেকে সেকালের বাবুসমাজের বিবরণ পড়ে তিনি শোনালেন। বাবুরা নাকি ‘খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা ও মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতি সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইত।’
যেন মৌচাকে ঢিল পড়েছে। গবেষক অনর্গল বলে যান অক্ষয়কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে নাকি কর্তাভজাদের সম্পর্কে গালমন্দ আছে। যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘হিন্দু কাস্টস অ্যান্ড সেক্টস’বইতে ঘোষপাড়াকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছেন সেই ১৮৯৬ সালে। ওয়ার্ড সাহেব বা উইলসন সাহেবও নাকি রেয়াৎ করেননি। ‘এই তো’ ‘এই তো’ বলে ভদ্রলোক শেষমেষ বিনয় ঘোষের বই খুলে একটা জায়গা পড়তে লাগলেন:
এ বৎসর দোলে প্রায় ৬৫ হাজার লোকের সমাগম হইয়াছিল। যাত্রীদিগের মধ্যে চৌদ্দ আনা স্ত্রীলোক। কুলকামিনী অপেক্ষা বেশ্যাই অধিক; পুরুষদিগের সকলেই প্রায় মূর্খ।
দেখিলাম জনা ২০ রোগী আরোগ্যলাভ করিবার আশায় দাড়িম্বতলায় হত্যা দিয়া পড়িয়া রহিয়াছে। অন্য অন্য ধর্মাবলম্বিদিগের ন্যায় ইহাদিগের বুজরুকীও অল্প নয়। কোন পরিচিত ব্যক্তিকে বোবা সাজাইয়া ‘বোবার কথা হউক’ প্রভৃতি বলিয়া রোগ আরাম করিতেছে।
অনেক লোকের মুখে শুনিয়াছি এই ধর্মাবলম্বিদিগের মধ্যে শ্রীবৃন্দাবনের প্রকৃত কৃষ্ণলীলাটাই অনুষ্ঠিত হয়।
আমি জানতে চাই এ বিবরণ কবেকার? জানা যায় ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৩ চৈত্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’ কাগজের ২১ সংখ্যা থেকে প্রতিবেদন খুঁজে পান বিনয় ঘোষ। আশ্চর্য হই। একটা গ্রাম্য লৌকিক ধর্ম সেকালে কলকাতার এত মানুষের বিদ্বেষ সয়েছিল? কর্তাভজাদের আচরণ সকলের এত খারাপ লেগেছিল? নীতিবাদী ব্রাহ্ম অক্ষয়কুমার কিংবা নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ যোগেন্দ্রনাথ না হয় খানিকটা ধর্মান্ধ হয়ে কর্তাভজাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, কিন্তু উদার সমন্বয়বাদী শ্রীরামকৃষ্ণ? তিনি কেন এঁদের ভুল বুঝেছিলেন? কমলবাবুও কি রামকৃষ্ণপন্থী বলেই ওঁদের বিষয়ে অসহিষ্ণু?
পরদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা স্বস্তিকর তথ্য মিলল নবীনচন্দ্র সেনের ‘আমার জীবন’বইয়ের চতুর্থভাগে। ১৮৯৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল ঘোষপাড়ার মেলার তত্ত্বাবধান। সরেজমিন সেই মেলা দেখে নবীনচন্দ্র লেখেন:
আমার বোধ হইল ‘কর্তাভজা’ রূপান্তরে হিন্দুদের ‘গুরুপূজা’ মাত্র। তাহাদের ধর্ম বেদান্তের মায়াবাদের প্রতিবাদ। যে-রামশরণ পাল বেদ-বেদান্ত প্লাবিত দেশে এরূপ একটা নূতন ধর্ম প্রচার করিয়া এত লোকের পূজাৰ্হ হইয়াছিলেন, তিনি কিছু সামান্য মানুষ ছিলেন না। যথার্থই কাল্পনিক মূর্তির পূজা না করিয়া এরূপ পূজনীয় ব্যক্তির পূজা করিলে ক্ষতি কি? এখন যে harmony of scripture বা ধর্মের সামঞ্জস্য বলিয়া একটা কথা শুনিতেছি, দেখা যাইতেছে, এই রামশরণ পালই তাহা সর্বপ্রথম অনুভব করিয়াছিলেন। সকল ধর্ম, সকল আচার সত্য—এমন উদার মত এক ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কোনও ধর্মসংস্থাপক প্রচার করেন নাই। অতএব রামশরণ পাল, আমি তোমাকে নমস্কার করি। আমি এতদিনে কর্তাভজা ধর্ম কি বুঝিলাম, এবং ভক্তিপূর্ণ-হৃদয়ে আমার শিবিরে ফিরিলাম।
পরিষদ পাঠাগারেই দেখা হয়ে গেল এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে। উনিশ শতকের বাঙালিসমাজ নিয়ে তাঁর কাজ। আমার সমস্যা তাঁর কাছে ব্যক্ত করতেই দিলেন একগাদা বইয়ের ফর্দ। সেসব বই ঘেঁটে দেখা গেল: উনিশ শতকের গোড়ায় কর্তাভজাদের নিয়ে কলকাতার ব্রাহ্ম খ্রিস্টান আর হিন্দুধর্মের মানুষদের খুব মাথা-ব্যথা ছিল। প্রথমে ‘ইতরলোকদের ধর্ম’, ‘ওদের জাতপাঁত নেই’, ‘ওরা কদর্যভক্ষণ করে’, ‘মেয়েমানুষ নিয়ে ওরা গোপনে রাসলীলা করে’—এ সব কথা খুব রটানো হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ আর জাত-বৈষ্ণবদের মধ্যে থেকে বহুলোক ভেতরে ভেতরে কর্তাভজা ধর্মে আকর্ষণ বোধ করছিলেন। সেকালের কলকাতার কৈবর্ত তিলি গন্ধবণিক শাঁখারী বেনে তাঁতি এইসব নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে বা নবশাখদের কাছে ‘ঘোষপাড়ার মত’ বা সত্যধর্ম খুব সহজ সরল সাদাসিধা বলে মনে হতে লাগল। তাঁরা নিজের নিজের এলাকায় ‘আসন’ বানালেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় শুরু হল সমাবেশ। প্রথমে গোপনে পরে সগর্বে। বর্ণহিন্দুদের মধ্যে অনেকে, এমনকী অনেক বড় মানুষ কর্তাভজাদের ব্যাপারে ক্রমে উৎসাহ দেখালেন। যেমন ভূকৈলাসের মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল। ১২২১ সালে তিনি বেনারসে ‘করুণানিধানবিলাস’নামে যে বিরাট কৃষ্ণলীলার কাব্য লিখেছিলেন তাতে রামশরণ পালকে উল্লেখ করেছিলেন অবতার বলে।