: হিসেবের বাইরে একটা আনন্দ আছে যে! মানুষ দেখার আনন্দ। অনেক মানুষ আসবে। অনেক মানুষের সেবা দেওয়া যাবে। সব জাত সব বর্ণের মধ্যে সেই মানুষকে, সেই আসল মানুষকে দেখা যাবে।
: অত মানুষের ভিড়ে আসল মানুষকে চিনবেন কী করে?
: সে চেনা যায় আজ্ঞে। চকমকি দেখেছেন? লোহা আর পাথরের ঘর্ষণে সত্যিকারের আগুন এসে যায়। তেমনই মানুষে মানুষে মেশামেশি থেকে আসল মানুষ ভেসে ওঠে। এ আমরা কত দ্যাখলাম। ও সব হিমালয় টিমালয় গেলে কিস্যু পাবেন না। লালন বলে ‘মানুষ ধরলে মানুষ পাবি/ও সব তীর্থব্রতের কর্ম নয়’। তাই আপনাকে বলছি, এ সব বাউল ফকিরদের পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করবেন না। মেলায় মিশবেন।
রয়েল ফকিরের কাছ থেকে এ সব আমার শোনা, তা অনেক বছর তো হল। রয়েল ফকির। নামটার মতো মানুষটার মধ্যে ছিল রাজকীয়তা। লম্বা সুগঠিত চেহারা। আমাকে খুব সহজে বুঝিয়েছিল: বাবু, আসল মানুষ কাছে পিঠেই নড়ে চড়ে কিন্তু খুঁজলে জনমভর মেলে না। দুই ভুরুর মাঝখানে যে সূক্ষ্ম জায়গা তাকে বলে আরশিনগর। সেইখানে পড়শী বসত করে। পড়শী মানে মনের মানুষ। আরশি ধরলে পড়শী আর পড়শী ধরলে আরশি, কিছু বুঝলেন?
: অন্তত এইটুকু বুঝলাম যে আরশিনগরে পৌঁছোতে গেলে মানুষকে এড়ালে চলবে না, পড়শী ধরতে হবে।
: বিলক্ষণ। বাবু, আপনার আসল কথাটা বোঝা সারা। এবারে ক্রিয়া আর করণ।
: সেটা কী বস্তু?
‘সেটাই আসল’ রয়েল ফকির বলে, ‘মনে মনে জানা, ধ্যানে জ্ঞানে জানা, এবারে তাকে দেহ দিয়ে কায়েম করা, সেটাই আসল। যেমনধারা আপনি শুনলেন গাছে সুন্দর ফল পেকেচে। শুনলেই তো হবে না। দেখতে হবে, খুঁজতে হবে, গাছে উঠতে হবে এবং সবশেষে খেতে হবে। তবে সাঙ্গ হল। তা অত কথায় কাজ কী? আপনি আমাদের বড় বড় ক’টা বিখ্যাত মেলায় যাবেন, আচ্ছা আমার সঙ্গেই যাবেন। আমি সব বুঝিয়ে দেব। তা হলে সেই কথাই রইল। আপনি প্রথমে যাবেন দোলের সময় ঘোষপাড়ায়। সতীমার মেলায়। দোলের আগের দিন প্রভাতে আমার আখড়া থেকে রওনা। চলে আসবেন তৈরি হয়ে। থাকতে হবে তেরাত্তির। ব্যাস পাকা কথা।’
আমি বললাম: কথা পাকা। কিন্তু ওই মেলা সম্পর্কে আগে বইপত্তর থেকে আমি একটু লেখাপড়া করে নেব। খুব বিখ্যাত মেলা তো। দুশো বছরের মতো প্রায় বয়েস। মেলাটা সম্পর্কে একটু খুঁটিনাটি জেনে নেব।
: সে সব জেনে নেবেন বইকী। আপনারা জ্ঞানের পথের লোক তো। সব বাহ্য বিষয়ে নজর তাই। তবে আমরা হলাম ভাবের পথের লোক। আমাদের চলতে চলতেই সব বোঝা হয়ে যায়।
: কতদিন ধরে যাচ্ছেন ঘোষপাড়ার মেলায়?
‘সে কি আজ থেকে গো?’ রয়েল ফকির তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সে আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক। অর্থাৎ আমার দাদু-গোঁসাইয়ের কাল থেকে।’
: দাদু-গোঁসাই মানে?
: কথাটা ধরতে পারলেন না বুঝি? আমার যিনি বাবা আবার তাঁর যিনি বাবা তিনি আমার কে? না, দাদু। তেমনই আমার যিনি গুরু তিনি আমার গোঁসাই। আর আমার গোঁসাইয়ের যিনি গুরু তিনি আমার দাদু-গোঁসাই। এবারে বুঝলেন?
: বুঝলাম। কিন্তু এইটে বুঝলাম না যে যারা বৈরাগ্যের পথে নেমেছে তারা সব সংসারী লোকের মতো দাদু-নাতি সম্বন্ধ পাতায় কেন?
: শুধু দাদু-নাতি নয়। গুরু পিতা শিষ্য সন্তান। গুরুপত্নীকে শিষ্য বলে মা-গোঁসাঞি। আমাদের চলতি কথায় শিষ্যসেবক না বলে বলে শিষ্যশাবক। সব সম্পর্কে বাঁধা। আমাদের পথ যে রসের পথ বাবা। তালগাছ দেখেছেন? খেজুর গাছ? সব খাড়া উঠে গেছে মাটির দিকে ফেরে না আর। কামিনীকাঞ্চনত্যাগী ধর্ম ওইরকম—মাটি আর মানুষের দিকে নজর নেই। আর আমাদের সতী মার ধর্ম হল গৃহীধর্ম। বটগাছের মতন। কেবলই ঝুরি নামছে। ছেলেপুলে নাতিপুতি রস টানছে মাটি আর মানুষের কাছ থেকে। গোঁসাঞি, মা-গোঁসাঞি, দাদু-গোসাঞি সব নিয়ে আমাদের চলা।
: এই সতী মার ধর্ম বা কর্তাভজা মতের শুরু কোথা থেকে?
: কেন? আউলচাঁদ থেকে।
: আউলচাঁদ কে?
: আউলচাঁদ গোরাচাঁদের অবতার। শ্রীক্ষেত্রে গোপীনাথের মন্দিরে গোরাচাঁদ হারিয়ে যান। তারপরে আউলচাঁদের রূপ নিয়ে এই ঘোষপাড়ায় তাঁর উদয়। এবারে তাঁর জন্ম হয়েছে গৃহীদের জন্যে কর্তাভজা ধর্মের পথ তৈরি করার কারণে। তিনিই আদিকর্তা। তাঁর থেকেই এই মত।
: তাহলে সতী মা কে?
‘তা হলে শোনেন সবিস্তারে’ রয়েল বেশ ভব্যিযুক্ত হয়ে বসে ভক্তিমানের মতো বলে; ‘আউলচাঁদের ছিলেন বাইশজন শিষ্য। তাদের মধ্যে প্রধান হলেন রামশরণ পাল। সাকিন ঘোষপাড়া মুরতীপুর, জাতি সদ্গোপ। তাঁর পরিবারের নাম সরস্বতী। সেই সরস্বতী থেকে সতী। বুঝলেন?’
আমি তর্ক তুললাম: তা কী করে হয়? সরস্বতী থেকে সতী? কেমন করে?
‘হয়, হয়’ রহস্যের হাসি রয়েল ফকিরের মুখে, ‘আপনি ধৰ্ম্মের ভেতরকার সুলুক জানেন না, তাই এমন ধন্দ। আচ্ছা, আপনারে বোঝাই। সরস্বতীর আদ্যক্ষর ‘স’ আর শেষঅক্ষর ‘তী’ হল? এই দু’ই মিলে সতী। এবারে বুঝলেন?’
আমতা আমতা করে বলতেই হল, ‘ব্যাপারটা বেশ মজার। এ রকম আরও নমুনা আছে নাকি?’
: বিলক্ষণ। এই যেমন ধরুন রামশরণ আর সতী মার একমাত্র সন্তান হলেন রামদুলাল ওরফে দুলালচাঁদ। তো সেই দুলালের ‘লাল’ আর চাঁদের বদলে ‘শশী’ বসিয়ে তিনি নাম নিলেন লালশশী। এই লালশশীকে আমরা বলি ‘শ্ৰীযুত’। তাঁর লেখা গানই আমাদের ধর্মসংগীত। সে গানের বইয়ের নাম ‘ভাবের গীত। তাকে আমরা বলি আইনপুস্তক। শুক্কুরবারে সন্ধেবেলা আমরা একসঙ্গে বসে শ্ৰীযুতের আইনপুস্তক থেকে গান করি।