১.
একজন সাধককে আমার প্রশ্ন: আপনি বাউল?
উত্তর: আমি সংসার করি নাই।
প্রশ্ন: আপনি তো ফকির? আপনার ছেলেমেয়ে?
উত্তর: সন্তান? পাঁচ হাজার। আমার পাঁচ হাজার শিষ্যশাবক। তারাই সন্তান।
জানেন না ফকিরি দণ্ড নিলে আর সন্তান হয় না?
শিষ্যসেবক নয় শিষ্যশাবক। ফকিরি দণ্ড বস্তুটি কী? বাউল কি সংসার করে না?
২.
একজন উদাসীনকে আমি জিজ্ঞেস করি: আজ কী খেলেন?
উত্তর: খাওয়া নয়, বলুন সেবা। আজ সেবা হল পঞ্চতত্ত্ব।
প্রশ্ন: পঞ্চতত্ত্ব মানে? সে তো চৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈত…
উত্তর: আরে না না, পঞ্চতত্ত্ব মানে চাল ডাল আর তিন রকমের আনাজ।
৩.
এক আখড়ায় খুব ফিসফিস করে এক গুরুস্থানীয় উদাসীনকে জিজ্ঞেস করলাম: একটা গানে শুনলাম ‘ভগলিঙ্গে হলে সংযোগ/সেই তো সকল সেরা যোগ॥’ তার মানে? এখানে কি মৈথুনের কথা বলা হচ্ছে?
একগাল হেসে উদাসীন বললেন: মৈথুন? হ্যাঁ মৈথুনই তো? তবে কী জানেন, এর মানে আলাদা। শুনুন তবে: ‘গুরুবাক্য লিঙ্গ হয় শিষ্যের যোনি কান।’ এবারে বুঝলেন?
বুঝলাম যে আগে ভুল বুঝেছিলাম।
এ তো গেল ভুলবোঝা। মুশকিল আসতে পারে আরেক দিক থেকে। যদি প্রশ্ন করা যায়, আপনি কি বাউল সম্প্রদায়ের? উত্তর পাওয়া যাবে, তা বলতে পারেন। আবার যদি ওই উদাসীনকে জিজ্ঞেস করি, আপনি ফকির? উত্তর হবে, হ্যাঁ ফকিরও বটে। এবারে অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করতে হয়, আমি যা-ই জিজ্ঞেস করি আপনি হ্যাঁ বলেন। আপনি সত্যিই কী বলুন তো? উত্তর মিলবে, আমি মানুষ। মানুষভজা।
এ সব কথার স্পষ্ট মানে কী? আমরা কী সিদ্ধান্ত করব? আসলে এ সব উদাসীনদের সাধনের মূল কথা গোপনতা। অসম্প্রদায়ীদের কাছে হয় কিছু বলেন না, কিংবা উলটো-পালটা বলে বিভ্রান্তি এনে দেন। ওঁরা একে বলেন আপ্ত সাবধান। এর মূল বক্তব্য হল: আপন সাধন কথা/না কহিও যথা তথা/আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান।
আরেক রকম আছে ধন্দবাজি। সেবার যেমন ধাপাড়ার ইমানালি শাহজি ফকির তার খাতা খুলে বললে: লিখুন বাবু কারের খবর। অন্ধকার, ধন্ধকার, কুয়াকার, আকার, সাকার, ডিম্বাকার, নিরাকার, শূন্যাকার, হাহাকার, হুহুকার, নৈরাকার—এই হল একুনে এগারোকার আর চারকার গোপন।
আমি জানতে চাইলাম, এ সবের মানে কী?
মুরুব্বির চালে মাথা নেড়ে শাহজি বললে, এ সব নিগূঢ় তত্ত্ব। আপনি বুঝবেন না।
আসলে শাহজিও কিন্তু কিছু জানে না। কথাগুলো কোথা থেকে টুকে রেখেছে। শহুরে পণ্ডিতম্মন্যরা যেমন ক্রফো-গদার আওড়ায়!
এখন ভাবি, প্রথম যখন এইসব উপধর্মের সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি তখন উলটো-পালটা সব দেখে শুনে চমকে যেতাম। সবচেয়ে বেকুব বনতে হত গানের আসরে। হয়তো মচ্ছবের শেষে সারারাত চলল গানের আসর। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বসে সে গান শুনছে মৌজ করে, গায়ক গাইছে প্রাণ খুলে। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তকমাধারী, অথচ সে গানের বিন্দুবিসর্গ বুঝছি না।
এ সব গানকে বলে ‘শব্দ গান।’ একজন প্রথমে গানে তত্ত্বকথা তোলে প্রশ্নের আকারে, আরেক গায়ক তার জবাব দেয় আরেক গানে। প্রথম গানকে বলে ‘দৈন্যতা’, জবাবি গানকে বলে ‘প্রবর্ত’। এ সব আমি ক্রমে ক্রমে শিখে নিই। পরে দেখেছি এ সব নিগূঢ় ভাষার প্রয়োগ লাগসই করতে পারলে ফলও মেলে হাতেনাতে। সেবার যেমন আমাদের মফস্বল শহরে পানের দোকানে এক গ্রাম্য বাউল জনপ্রিয় সব রেকর্ডের গান গাইছিল। আমি ফস করে বলে বসলাম, ‘ও সব ফক্কিকারি রসের গান গেয়ে কী হবে সাঁই, একটা দৈন্যতার গান হোক।’
ব্যস্, কেল্লাফতে! গায়কের চোখমুখে আমার সম্পর্কে সে কী শ্ৰদ্ধার জানান! যেন দরদী পেয়েছে মরমীকে। বলেই বসল: আহা কী মান্যমান মহাশয়। শোনেন তবে ‘আগে শান্তিপুরে চলোরে মন তবে গুপ্তিপাড়ায় যাবি।’
আমি সেই ভিড়ের দিকে সগর্বে তাকালাম। ভাবখানা যেন, দেখলে আমার এলেম! কী না আমি জানি এ গানের মর্ম। এ গানে বলা হচ্ছে দেহমনকে শান্ত করলে তবে গুপ্তিপাড়া অর্থাৎ গুপ্ততত্ত্ব জানা যাবে। এমনই করে আমি জানতে পারি অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনি। কুমির মানে কাম। লতা মানে সন্তান। চন্দ্ৰসাধন মানে মল মূত্র পান ইত্যাদি।
গোট পল্লীর আর্জান শানু ফকির বলেছিল: নিজের শরীরের বস্তু কি ঘেন্নার জিনিস? বস্তু রক্ষা আমাদের ধর্ম, শুক্ররক্ষা। অযথা শুক্রক্ষয় আর সন্তানজন্ম মানে আপ্তমরণ, নিজেকেই মারা। সন্তানজন্ম দেওয়া চলবে না। তবে পতন কি নেই? আছে। যাদের কাম মরেনি তারা বারে বারে জন্মদ্বারে যায়। আমরা তাকে বলি ‘যোনিতে পতন’। তাই বলে নারী আমাদের ত্যক্ত নয়। নারীকে নিয়েই আমাদের সাধনা। বিন্দু সাধন। যাকে বলে রসের ভিয়ান। দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে যেমন ক্ষীর তেমনই। আর ওথলায় না। কামকে তেমনই পাকে চড়িয়ে শান্ত করতে হবে। আমাদের আপ্তজ্ঞানে বলে:
আপন জন্মের কথা যে জানে রে ভাই
সকল ভেদ সেই তো জানে তার তুলনা নাই।
রজ বীর্য রসের কারণ
এ দেহ হইল সৃজন
যারে ধ’রে সৃজন পালন তারে কোথা পাই?
সেই আসল মানুষ সাঁইকেই আমরা খুঁজি। বুঝলেন এবার?
লোকধর্ম আর লোকসংগীত নিয়ে গ্রামে গ্রামে বছরের পর বছর একটানা ঘুরে বুঝেছি তার অনেকটা হেঁয়ালি, বেশ কিছুটা শহুরে অজ্ঞ লোককে বোকা বানানোর চটকদারি, কিন্তু ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষটিকে ঘা দিতে পারলে বেরিয়ে আসে চাহিদার অতিরিক্ত রসদ। এ জন্যে শিখতে হয় তাদের সাংকেতিক ভাষা। জানতে হয় লোকধর্মে ‘দীক্ষা’ আর ‘শিক্ষা’ আলাদা জিনিস। কাউকে তার নিজস্ব ধর্মমত বলাতে গেলে ‘আপনি কি বাউল?’ ‘আপনি কি ফকির?’—এভাবে জিজ্ঞেস না করে বলতে হয় ‘আপনার কি সতীমার ঘর না দীনদয়ালের?’ বা ‘আপনি কি পাটুলী স্রোতের?’ সঙ্গে সঙ্গে উদাসীনের চোখে খেলে যাবে সুপরিচয়ের ঝলক। একবার এক বাউল আমাকে পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করেছিল: মাটির কাজ বোঝো।