আরে ওই বৃন্দাবন হ’তে এলো সাড়ে তিন রতি
ওই পথেতেই এয়োতনের যেন থাকে মতি ॥
আমি বললাম: এই তা হলে এয়োতনের সার কথা?
: আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে আরও কথা আছে। হাড়িরাম বলে গেছেন সন্ধে-রাতে স্ত্রী সহবাস করলে যে সন্তান জন্মায় সে হয় চোর। আবার সন্ধ্যার পর কিন্তু রাত বারোটার মধ্যে সঙ্গম থেকে যে সন্তান হয় সে হবে ডাকাত। তা হলে বুঝলেন তো রাত বারোটার পরই সহবাস ভাল। তাতে সুসন্তান হয়। আর ভোরবেলার সহবাসে জন্মায় দেবগুণান্বিত সন্তান!
বিপ্রদাস ব্যাপারটাকে গুছিয়ে বলল: এয়োতনের ধর্ম তা হলে কী দাঁড়াল? শুধু সন্তানের জন্য জন্মদ্বারে যাওয়া, সেও ওই সাড়ে তিন রাত্তিরে। অন্যদিন সহবাস নিষিদ্ধ। স্ত্রী ঋতুমতী না হলে বৃথা সঙ্গম অর্থাৎ কাম এয়োতনের ধর্ম নয়।
প্রজনন তত্ত্বের এহেন ব্যাখ্যা আমি কখনও শুনি নি, তাই কৌতুহল জাগল। বিপ্রদাস ক্রমে বুঝিয়ে দিল ‘নিত্যন’ হল এয়োতনের পরের ধাপ। গৃহস্থ ধর্মে এয়োতন মেনে একটা-দুটো সন্তান জন্মালে নিতে হবে নিত্যনের পথ। তখন মনের মধ্যে আনতে হবে সংসারে অনাসক্তি আর জন্মদ্বারে ঘৃণা। জন্মদ্বারকে পচা গর্তরূপে ভেবে তাকে চিরতরে ত্যাগ করতে হবে। সংসার আর জগতের আইন কানুনের বাইরে গিয়ে নিত্যপুরুষ হাড়িরামের ধ্যান করতে হবে। নির্জন মাঠে, নদীর ধারে বা বেলতলায়। মেহেরপুরের বৃন্দাবন আর নিশ্চিনপুরের রাধারাণী নিত্যনের পথে আছে।
কিন্তু সবচেয়ে কঠিন সাধনা বোধ হয় খাসতনের। একা হাড়িরাম শুধু এ সাধনা করতে পেরেছিলেন। আর কেউ পারবে না। খাসতন হল চরম মুক্তির সাধনা। পৃথিবীর আলো হাওয়া আকাশ গাছপালা নদী পাহাড় বন মাঠ এরা খাসতালুকের প্রজা। স্বাধীন। এরা কাউকে খাজনা দেয় না। এদের বেঁচে থাকতে গেলে কোনও মূল্য দিতে হয় না। মানুষকে বেঁচে থাকার মূল্য দিতে হয় বীর্যক্ষয় আর বীর্যগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। যে মানুষ কোনওদিন তার বীর্যক্ষয় করে নি সে খাসতনের সাধক। একমাত্র হাড়িরাম তা পেরেছিলেন, তাই তিনি জগৎস্রষ্টা কারিকর।
এই অবধি বোঝার পর আমি বললাম: এবারে আমি বোধিতন বুঝেছি। বোধিতন মানে কামের দ্বারে একেবারে বন্দিত্ব আর তার জন্যে অনুতাপ। তাই না?
: ঠিক তাই। বোধিতন হল জ্ঞানপাপীর দশা। আমরা সবাই তাই। হাড়িরাম বলে গেছেন, যে প্রতিদিন সঙ্গম করে আর অকারণ বীর্যক্ষয় করে সে পড়ে বোধিতনের ফাঁদে। হাড়িরামের সব শিষ্য এই বোধিতন থেকে মুক্তি খোঁজে, কাঁদে। নিত্যনের জন্যে চোখের জল ফেলে। এই আমার কথাই ধরুন। প্রত্যেকদিন দু’বেলা বেলতলায় মাথা কুটি আর কারিকরকে বলি, খাসতন তো পাব না এ জন্মে, অন্তত নিত্যনের পথে একটু এগিয়ে দাও। গোষ্ঠদাসের গান শুনুন—
বোধিতনে বদ্ধ হয়ে থেকোনা রে মন আমার
হাড়িরামের চরণ বিনে গতি নাহি আর।
আর অন্য উপায় দেখিনে থাক একিনে
আবার মানব হবি যদি হাড়িরামের চরণ করো সার ॥
গানের করুণ সুর সমস্ত পরিবেশকে গাঢ় করে দিল। যেন আমার চেতনা থেকে অস্পষ্টতা কেটে গিয়ে উদ্যত সত্যের মতো আকাশে জেগে রইল শেষ রাতের দীপ্ত চাঁদ। গানের ভাবে আর সুরে সমস্ত পৃথিবীর কামমোহিত সকল মানুষের অসহায় মাথা-কোটা যেন আমি শুনতে পেলাম। মনে হল এ কোনও লৌকিক ধর্মের বানানো তত্ত্ব নয়। এর মধ্যে চিরকালের লৌকিক মানুষের অসহায় অনুতাপ আর কান্না।
গানের সুর শেষ হলেও কান্না থামেনি বিপ্রদাসের। আমি তার পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে মমতার সঙ্গে কাঁধে হাত রাখলাম। অমন শালপ্রাংশু মানুষটা আত্মধিক্কারে একেবারে কুঁকড়ে গেছে। আমি তার হাত ধরে বেলতলার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললাম শান্ত হও। হাড়িরামকে ডাকো। তোমার তো অনেক বয়স হয়েছে। আর ভয় কী?
বিপ্রদাস করুণ কণ্ঠে বলল: বাবু, আমার ভিতরের পশুটা যে আজও মরে নি।
শেষ চাঁদের ঝিলিক মারা আলোয় পা ফেলে বেলতলায় গিয়ে দাঁড়াই দু’জন। গাছতলায় হাড়িরামের খড়মের কাছে জ্বেলে দেওয়া প্রদীপ এত হাওয়াতেও নেভেনি। ধ্যানতন্ময় রাধারাণীর মুখে পড়েছে সেই আলো। সেইদিকে চেয়ে ভাবলাম কোথায় গেল মেহেরপুরের সেই মেধাবী সিদ্ধ সাধক? কোথায় তার তনু সদানন্দ শ্ৰীমন্ত নুটু জগো দক্ষ? নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে, অবনত অবমানিত মানুষদের বাঁচাতে তৈরি হয়েছিল যে শাস্ত্র তাতে তো কই একফোঁটাও কলঙ্ক লাগেনি।
***
* এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দ্র. ‘বাঙলায় বাউলবিরোধী আন্দোলন: প্রেক্ষিত লালন শাহ’ আবুল আহসান আহসান চৌধুৰী। চৌধুরী। লালন স্মারক গ্রন্থ। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ ১৯৭৪.
১.২ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
সব মানুষের বোধহয় ভেতর ভেতর চেষ্টা থাকে তার মনের অতলে ডুব দেবার। সকলেই কি তাই ভালবাসে তার আত্মনিঃসঙ্গতার স্বাদ? সকলে কি সেইজন্য ভিড়ের কথা বলে, কাজের চাপের কথা বলে? খুলতে চায় কাজের জট, এড়াতে চায় ভিড়ের জটিলতা। বহুজনতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা খুঁজতে চায় নিঃসীম একাকিত্ব। অথচ কতবার এর উলটোটাই দেখেছি। সাধক যারা, যারা দেহাত্মবাদী, চলতি কথায় যাদের বলে আউল বাউল দরবেশ, তাদের গভীর নির্জন সাধনায় কেমন করে যেন চিরকালের নিঃসঙ্গতা কায়েম হয়ে যায়। ভিড়ে তাদের ভয় থাকে না নিজেকে হারাবার। বোধহয় সেইজন্যেই তাদের সারাবছর ধরে এত মেলা আর মহোৎসব, দিবসী আর পার্বণ। কতবার সোৎসাহ আমন্ত্রণ পেয়েছি এ সবে। ‘আসবেন ১৪ই ফাগুন মচ্ছবে, আমার গুরুর আখড়ায়। খুব আনন্দ পাবেন।’ আসলে আনন্দ সবচেয়ে বেশি আমন্ত্রণকর্তার। এ তো আমাদের শহরের ক্লিষ্ট কর্তব্যতাড়িত সমাবেশ নয়। কোথায় একটা প্রাপ্তির সানন্দ বিস্তার আছে দেহতত্ত্ববাদীর ডাকে। বহুসময় জিজ্ঞেস করেছি: কী আনন্দ পান? খরচও তো প্রচুর।