বিপ্রদাস যখন ডাকল তখন বেশ রাত। দুজনে চললাম বেলতলার দিকে। সারা গাঁ নিশুতি। গা ছম ছম নীরবতা। বেলতলায় একা রাধারাণী শুধু প্রদীপ জ্বালিয়ে ধ্যানস্থা। দুজনে তার কাছাকাছি বসতেই বিপ্র হুংকার দিল—
বীজে কলে একস্থানে উৎপত্তি আমার।
হাড়ি রামচন্দ্র সেই বল্ শক্তি
ইহার তত্ত্ব জানেন যেই ব্যক্তি
তাহার চরণে আমার কোটি কোটি দণ্ডবৎ।
তিনি যাহা বলেন হাড়িরামের বলের বলে॥
এরপরে বিপ্র আর রাধারাণী বেলতলার খড়মে ফুলজল দিয়ে দ্বৈত কণ্ঠে বলল—
হাড়িরামচন্দ্রের শ্রীচরণে ফুলজল দিলাম। ধরাতলে ধন্য হলাম।
রূপযৌবন নয়নমন অৰ্পণ করিলাম।
আমি দুর্বল। দুর্বলেরি বল তুমি। সকল জানে অন্তর্যামী।
কেবল তোমারই গুণ গাই। শুন অন্য কাহারে না জানি ॥
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। এলোমেলো হাওয়া। বিপ্রদাসের চোখ দুটো জ্বলছে। রাধারাণী ধ্যানস্থা। হঠাৎ বিপ্র গালবাদ্য বাজিয়ে বলল: জয় হক্ হাকিম হাড়িরামচন্দ্রের জয়। শুরু হোক সৃষ্টিতত্ত্ব।
রাধারাণী চোখ বন্ধ রেখেই বলতে লাগল—প্রথমে হক্ হাড়িরাম। তাঁর থেকে হৈমবতী আর নারদের জন্ম।
বিপ্র বলল: আর এই হৈমবতী হতেই জন্ম নিলেন ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব। ব্রহ্মার সন্তান দুটো—ঘামকাঞ্চনী আর ভগবতী। ভগবতী হতে অঘাসুর বকাসুর কংসাসুর আর লোহাসুরের জন্ম।
রাধারাণী বলল: আর ঘামকাঞ্চনীর সন্তান তিনজন—কালু মুরারি বাসুদেব। এই কালুর সন্তান হল—খাগর, নাগর, নীলাম্বর আর মন্মথ। মুরারির সন্তান—লোকনাথ, জীবন, আজির মেথর আর ভুষি ঘোষ। বাসুদেবের সন্তান—শানমৃগ, গজকন্যা আর মুনিবালক।
বিপ্রদাস আরেকবার গালবাদ্য বাজিয়ে বলল; এইখানে সাঙ্গ হল ব্রহ্মার বংশ। এবারে বিষ্ণু বংশ শোনেন রাধারাণীর মুখে।
‘বিষ্ণুর বংশ মস্ত বড়’, নিমীল চোখে বলে চলে রাধারাণী, ‘তাঁর তিন সন্তান— ঝো-কালি, মুছুন্দরী কালি আর মুসুক কালি। ঝো-কালির সন্তান নেই। মুছুন্দরী কালির সন্তান হাওয়া আর আদম। এই আদমের সন্তান হাবেল আর কাবেল। কাবেল হতে নিকাড়ি, জোলা আর রাজপুত জাতের জনম। ইদিকে হাবেল হতে সেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠানের জনম।’
বিপ্র বলল: এবারে শুনুন আমার ঠাঁই। সেখ থেকে জন্মাল চারটে জাত—জিন সেখ, পরী সেখ, হাইদুলি সেখ আর দুলদুলি সেখ। সৈয়দ থেকেও চারটে জাত—হুমানী সৈয়দ, আলী সৈয়দ, দুমরা সৈয়দ আর হুরানা সৈয়দ। মোগল হতে চার জাত—লাল মোগল, নীল মোগল, সুন্নি মোগল আর শিয়া মোগল। পাঠান হতেও চার জাত—ছুর, ছুরানি, লুধি, লোহানি। ব্যাস। এবারে বাকি আছে মুসুক কালির বংশ বেত্তান্ত। শোনেন তা রাধারাণীর ঠেঁয়ে।
: মুসুক কালির তিন সন্তান—পরাশর মুনি, নমস মুনি আর ঋষভ মুনি। এই পরাশর মুনির এগারো সন্তান—যথা, ছাগ বাঘ নাগ শকুন মুসক মশক হাজত ঘোড়া বিড়াল উট আর হনুমান। ইদিকে নমস মুনির সন্তান একুনে বারোজন, যথা—জরলাল ফরলাল গ্রহক নৈনি শিউলে নুলো আলতাপেটে মুগলবেড়ে মালদহী ঝাপানি পুরকাটা আর চং।
বিপ্র বলল: ঋষভ মুনির চার ছেলে—দরশন নরশন পরশন আর পদ্ম। এখন নরশন থেকে হল নাপিত। পরশন থেকে ধাই আর পদ্ম থেকে হল মুচিরাম দাসের জন্ম। দরশনের সন্তান তো অজস্র। গুণে নেন বাবু। দোবে চোবে তেবে পাঠক পাঁড়ে উবিদ্ধি তেওয়ারি মিশির মেতেল দেবেল ঠাকুর বিষণ আর শুকুর। তেরোজন হল? এবারে সৃষ্টিতত্ত্ব সাঙ্গ করো।
রাধারাণী বলল: রইল বাকি শিবের অংশ। শিবের সন্তান কার্তিক গণেশ আর সরস্বতী। কার্তিকের সন্তান অর্জুন, গণেশের সন্তান ভুঁইমাসুর। আর সরস্বতী চিরকুমারী ব্রহ্মচারী।
বিপ্র সেই নিশীথ রাত্রিকে কাঁপিয়ে বলল: ইতি নমো সৃষ্টিতত্ত্ব। হক হাকিম হাড়িরামের নামে বলিহারি দাও।
বিপ্র আর রাধারাণী গদগদ চিত্তে এবং আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে একসঙ্গে তিনবার বলে উঠলাম—বলিহারি বলিহারি বলিহারি।
রাতের কত প্রহর তার নিশানা নেই। সবদিক শান্ত স্তব্ধ। শুধু অদ্ভুত তিনটে মানুষ যেন জেগে আছে এত বড় বিশ্বে। এই সৃষ্টিতত্ত্ব শুনব বলে আমরা তিনজনই একাহারী আছি। তাই নিয়ম। যে বলে আর যে শোনে দুজনকেই আহার নিদ্রা থেকে বিরত থাকতে হয় রাত দু প্রহর থেকে। কেমন যেন অবাক লাগছে সব কিছু। এতক্ষণ এ সব কী কথা শুনলাম?
কিন্তু বেশিক্ষণ সে বিস্ময় পোহানো গেল না। বিপ্রদাস বললে: এবার রাধারাণী একা যাপন করবে বাকি রাতটুকুন। আসুন আমরা একটু ওধারে গিয়ে কথা বলি। আমাদের তনের সাধনা আপনাকে বলব। সেটাই হাড়িরামের নিগূঢ় তত্ত্ব।
বেলতলার বিপরীত দিকে একটা ঘাসের জমিতে জমিয়ে বসতেই বিপ্র বলতে লাগল: আমাদের মতে গুরু নেই, সাধনসঙ্গিনী নেই। হাড়িরাম বলে গেছেন সবচেয়ে দামি সাধনা সেইটা যাতে ‘সখার সখী নেই, সখীর সখা নেই।’ একেই বলে খাসতনের সাধনা। আমাদের হাড়িরাম ছিলেন একমাত্র খাসতনের সাধক। কিন্তুক খাসতন বুঝতে হলে আগে আপনাকে বুঝতে হবে আর সব তনের থাক বা ঘর।
আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই কারণ বিপই বলে যাচ্ছে অনর্গল।
: হাড়িরামের ধর্ম বৈরাগ্যের নয়। এ হল গিয়ে গৃহীর সাধনা। তাই আমাদের সাধনার আদি থাক হল এয়োতন। তার মানে হাড়িরামের মনের মানুষ জন্মদ্বারে যাবে অর্থাৎ স্ত্রী সঙ্গম করবে শুধু সৃষ্টির জন্যে। তাই বৃথা সঙ্গম নয় আর রোজ সঙ্গম নয়। আমাদের মতে বৃথা বীর্যক্ষয় নরহত্যার সমান পাপ। তাই স্ত্রীলোকের রক্তস্রাবের সাড়ে তিনদিন পরে অর্থাৎ চতুর্থদিনে সহবাস করতে হবে সুসন্তান কামনা করে। এই সহবাসই এয়োতনের ধর্ম। ওই সাড়ে তিন দিনের সময় রক্তের রং হয় পীতবর্ণ। এই সাড়ে তিন আমাদের আপ্ততত্ত্ব। বলেই গান ধরল বিপ্রদাস—