: বোধিতন কী? আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
বিপ্র তুড়ি মেরে বলল: জানবেন জানবেন। সবই জানবেন। সে সব হল নিগুঢ় তত্ত্ব— বেদবেদান্ত ছাড়া। কারিকর যখন তোমাকে পেটিয়েছে আর মেহেরপুর যখন ঘুরে এসেছ তখন আপনার অজানিত কিছুই থাকবে না। এখন বসুন দু দণ্ড। স্নান সেবা হোক। ততক্ষণে আমি একটা ডুব দিয়ে বেলতলায় কাঁচাভোগ সেবা দিয়ে আসি।
বাইরে জ্যৈষ্ঠের অসহ্য দাবদাহ, দাওয়ায় বিশ্বাসী ভক্তদের স্নিগ্ধ সমাবেশ। আমার মনের পর্দায় ফিল্মের মতো ঘুরে যাচ্ছে মেহেরপুরের ভৈরব নদীর ধারে বলরামের মন্দিরের রহস্যময় উদ্ভাস—বৃন্দাবনের সরল মুখ আর বিশ্বাসভরা দুখানা আকুল চোখ। ভাবতে আশ্চর্য লাগছিল, দেড়শো বছরেরও আগেকার একজন ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী এদের পরিত্রাণের মন্ত্র এনে দিয়েছে। রক্তে দিয়েছে প্রত্যয়। পায়ের তলায় শক্ত মাটি। বেদ বেদান্ত ব্রাহ্মণ শাস্ত্র সব কিছু দলিত মথিত করে গ্রামে গ্রামে এ কোন গুপ্ত প্লাবন? অথচ এরা দীন দরিদ্র দুঃখভারনত। এদের রক্তে সত্যিই ডাকাতির নেশা আছে? এদের পূর্বপুরুষরা কি বেছে বেছে ব্রাহ্মণ আর উচ্চবর্ণের বাড়িতে ডাকাতি করত? সে কি তবে প্রতিশোধ? সবকিছু কেমন অলীক মনে হতে লাগল।
গেজেটিয়ারে দেখেছিলাম নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বয়স দেড়শো বছরের বেশি। আগে ও জায়গায় ছিল জঙ্গল। উচ্চবর্ণের অত্যাচারে কিছু শূদ্র এখানে পালিয়ে এসে জঙ্গল কেটে বসত করেছিল। তারপর একদিন সেই অবমানিত মানুষদের মধ্যে বলরাম তুলে ধরেছিলেন বিশ্বাসের ছবি, বাঁচার প্রত্যয়। সে সময়ে দীক্ষাপ্রাপ্ত তনু মহীন্দর রামচন্দ্র জলধর সদানন্দ শ্ৰীমন্ত রাজুরা আজ কোথায়? এদের মধ্যে কি তাদেরই সন্তান সন্ততি? সকলের বংশ কি এখানেই? নাকি তারা দেশান্তরে।
নব্বই বছরের পূর্ণ হালদার নম্রকণ্ঠে বললে: সকলের খবর তো জানা যায় না। তবে তনুর তে বংশ নেই, বিবাহই করেনি। দিনু বাংলাদেশের আমঝুপিতে ছিল। এখনও বংশ আছে। কুঞ্জর নাতি জয়দেব কাছেই ভবানীপুরে থাকে। ধনঞ্জয়ের বংশ আছে পঞ্চকোটিতে। রাজু ফকিরের আশ্রম আছে পলাশীপাড়া ঘাটে। সদানন্দর বংশ আছে পঞ্চকোটিতে। মহীন্দর শ্ৰীমন্ত দক্ষ আর জগো তো হাড়িরামের সঙ্গে মেহেরপুরে চলে গিয়েছিলেন। কী জানি কী হল। তাঁরা তো সব সিদ্ধ মানুষ। কারিকরের সঙ্গে আছেন।
: আচ্ছা, হাড়িরামের শিষ্যদের সম্পর্কে কোনও কিংবদন্তি বা অদ্ভুত গল্প নেই?
: তাঁরা তো সকলেই ছিলেন অদ্ভুত মানুষ। অলৌকিক। কেবল আমাদের শেখাবার জন্যে কারিকরের সঙ্গে মনুষ্যদেহ নিয়েছিলেন। তবে শুনেছি আমাদের নিশ্চিনপুরের শ্ৰীমন্ত হাড়িরামের সেবা করতে করতে একটি অঙ্গ পেয়েছিল। তাঁর জন্মেছিল এক রত্তি লেজ।
: তবে কি সে ছিল হনুমানের অবতার? তোমরা তাই মানো?
: কী করে বলি সে সব নিগূঢ় তত্ত্ব। তবে তিনি ছিলেন আমাদের প্রথম সরকার। তেনা থেকেই আমাদের শাস্তরের উৎপত্তি। তাঁর থেকেই সব শিক্ষা।
: তাঁর পরে কে সরকার হয়েছিলেন? সরকার কীভাবে ঠিক হয়?
: পুরনো সরকার দেহ রাখলে নতুন সরকার ঠিক হয়। শ্রীমন্তের পর কে হন আমরা জানি না। তবে আমার জ্ঞান হবার পর থেকে সাহেবনগরের গোষ্ঠকে সরকার দেখেছি। তাঁর দেহ চলে গেলে আমাদের সরকার এখন ধা’পাড়ার চারু মণ্ডল।
: সরকারের ছেলে বুঝি সরকার হয় না?
: হতে বাধা তো কিছু নেই। সে রকম গুণগরিমা জ্ঞান থাকলে হয়, হতে পারে। বাচক হতে হয়। হাড়িরামতত্ত্ব সকলকে বোঝাবার ক্ষ্যাম্তা চাই। সকলের মান্যমান হওয়া চাই। আর হতে হয় নিত্যনের সাধক। যেমন ধরুন, আমাদের আগেকার সরকার গোষ্ঠর ছেলে ফণী। খুব গুণগরিমাঅলা মানুষ। জ্ঞানবুদ্ধিও পাকা। কিন্তু গোষ্ঠের দেহ রাখার পর তাকে ‘সরকার’ করা গেল না।
: কেন?
: অনেকগুলো সন্তান তার। কোথায় এয়োতন থেকে নিত্যনের সাধনা করবে, তা নয় পড়ে গেল বোধিতনের ফাঁদে।।
: এ সব কথা তো কিছুই বুঝছি না। এয়োতন, নিত্যন বোধিতন…
পূর্ণ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ও সব বুঝবেন বিপ্রদাসের কাছে। এখন একটা গান শোনেন। যদি মর্ম কিছু বোঝেন। কাঁপা গলায় গান ধরল পূর্ণ—
এবার ভক্তিভাবে ভাবো তারে
নইলে উপায় নাইকো আর।
হাড়িরামের চরণ করে সার।
মন আমার বোধিতনে থাকলে পড়ে
পড়বি সব যুগের ফেরে দ্যাখ বিচারে।
বোধিতনে বদ্ধ হয়ে থেকোনাকো মন আমার
হাড়িরামের চরণ বিনে গতি নাহি আর॥
পূর্ণ বলল, ‘কারিকরের কী খেলা! এ গান গোষ্ঠদাসের রচনা অথচ তার নিজের সন্তান ফণী পড়ে গেছে এই বোধিতনের পাকে।’
এমন সময় হইহই শব্দে এসে পড়ল বিপ্রদাস। পূর্ণ তাকে কাছে ডেকে কানে কানে কী যেন সব বলল। বিপ্র এক লাফ মেরে বললে: হবে হবে সব হবে। সব শুনবেন। সে সব অনেক রাতের ব্যাপার। বেলতলায় শুনতে হয় সে সব তত্ত্ব। আমি বেলতলার কারিকরের কাছে হুকুম নিয়ে এসেছি। গানও শোনাব অনেক। কিন্তু জানেন তো আগে ভোজন পরে ভজন।
আমি বললাম: এও কি কারিকরের কথা নাকি?
বিপ্র গোঁফে তা দিয়ে বললে: না। এ কথাটা কারিকরের নয়। এটা তাঁর অধম পেটেল বিপ্রদাসের। এই তোরা সব বাড়ি যা এখন। স্নানসেবা সারগে যা। বাবু তো আর পালাচ্চে না। একবার এয়েচেন যখন তেরাত্তির বাস নিয়ম।
সারাদিনের দিগ্দাহ যখন জুড়িয়ে এল তখন নামল সন্ধ্যা মায়াময় রূপে। হু হু বাতাস। আকাশে একখানা মানানসই চাঁদ। বিপ্রদাস আর আরশিগঞ্জের সেই গায়ক একটানা গান গাইতে লাগল নদীর পাড়ে বসে। সঙ্গে একতারা আর আনন্দলহরীর সঙ্গত। কখন গান থেমে গেছে, কখন সবাই চলে গেছে, কিছুই জানি না। ঘুমের জড়িমা আমাকে একেবারে কাতর করে দিয়েছিল। ক্লান্ত শরীর আর শ্রান্তিহারী হাওয়া। আমার দোষ কী?