হক্ হাড়িরামচন্দ্র তোমাকে চালজল দিলাম
সেবা করুন আপনি।
জাতিতত্ত্ব ভাৰসত্য তোমা হতেই শুনি।
তোমায় ভাবি ধ্যানে জ্ঞানে আমার আর কোনও বাঞ্ছা নাই।
পলকে পলকে হাড়িরামচন্দ্র যেন তোমার দেখা পাই।
: হাড়িরামের মহোৎসব কোনখানে হয়?
: এখানেই। এই বেলতলাতেই সব। চত্তির মাসের একাদশী, জষ্টি মাসের সংক্রান্তি আর কাত্তিক মাসের একাদশী—এই তিনবার মচ্ছব। তা ছাড়া সঙ্কল্প, মানসিক সব এখানে। এখানেই তিনি থাকেন। কিন্তু এখন জষ্টিমাসের এই কাঠবেলায় বাছা তুমি অত বক বক কোরো না দিকিনি। তুমি ওই টিউকলের জলে মুখখান ধুয়ে বসুন। একটু তেনার পেসাদ সেবা হোক। কাঁচাভোগ।
ভক্তি ভরে রাধারাণী আমার হাতে তুলে দেয় এক খামচা টাটকা আখের গুড় আর পেতলের ঘটিতে ঠাণ্ডা জল। গরিব মানুষের দীন আয়োজনেও পূর্ণতার স্বাদ মেলে। পথক্লান্ত শরীর নিমেষে ঠাণ্ডা হয়ে মনে নেমে আসে স্নিগ্ধ প্রসন্নতা। বুঝি যে, বলরামীদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে রয়েছে সারল্য আন্তরিকতা আর আয়োজনহীন উপচার। যে সব বড় বড় উপাস্যকে পূজার ছলে আড়ম্বরে আমরা ভুলেই থাকি হাড়িরাম তেমন আরাধ্য নন। তিনি নিত্যজীবিত রয়ে গেছেন শ্রান্ত শ্রমজীবী মানুষের প্রতিটি ক্ষণে আর প্রাত্যহিক স্মরণে।
কথাটা আরও স্পষ্ট হল যখন বেলতলা থেকে পৌছলাম বিপ্রদাস হালদারের মেটে দাওয়ায়। ষাট ছুঁই-ছুঁই পেটা চেহারা বিপ্রর। মৎস্যজীবী। ইয়া দুখানা গোঁফ। আমাকে দেখেই হইহই করে হেঁকে উঠল, ‘আরে, আসুন আসুন। আপনি আসবেন সে কথা বি. ডি. ও সায়েব বলে পেটিয়েচে। তবে টাইম তো দ্যায় নি! তাই বেলান্ত পথ চেয়ে বসে আছি। বেলতলায় গিয়েলেন বুঝি। জয় হাড়িরামচন্দ্র। সবই তাঁর হেকমতের খেল। তা আমাদের ঘরে সেবা নেবেন তো দুপুর বেলা?’
সম্মতি জানাতেই আরেকবার হুংকার দিল: জয় হাড়িরামচন্দ্র। তিনি ব্রাহ্মণকেও সদবুদ্ধি দ্যান। ওরে কাঞ্চন বিটি, এ বাবুকে গামছা ঘটি দে। গরিবের ঘরের মুড়ি চা একটু খাওয়া। ভাত চড়া। আমি ততক্ষণে খ্যাপলা জালটা নিয়ে এই নদী পানে। যদি একটা মাছ মেলে।
আমি বললাম: এত বেলায় কি মাছ মিলবে?
‘সবই কারিকরের ইচ্ছে, তিনি যখন তোমাকে পেটিয়েছেন তখন মাছও পাটাবেন বৈকী’, বলে জাল হাতে এগোল বিপ্রদাস। বাড়ির একটু দূরেই খরস্রোতা নদীর রুপোলি ফালি দেখা যাচ্ছে দাওয়া থেকে। আমি বেশ দেখতে পেলাম বিপ্র নামল নদীর হাঁটুজল ছাড়িয়ে, ছুঁড়ে দিল খ্যাপলা জাল। তারপর জাল টেনে নিরীক্ষণ করে হাত তুলে দিল ওপরে। তার মানে এক খেপেই কেল্লা ফতে। প্রায় ছুটতে ছুটতেই উঠে এল। ধড়ফড় করছে হাতে একখানা পাঁচ-ছশো গ্রাম ওজনের মৃগেল।
আমি দাওয়ায় উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে বললাম: তুমি তো খুব ওস্তাদ মেছো দেখছি।
বিপ্র তার দাওয়ায় মাছটা রাখল। তারপরে পাকানো গোঁফে চাড়া দিয়ে একগাল হেসে বলল: এতে আমার আর কেরদানি কী আছে? সবই তাঁর হেকমৎ আর আপনার ভাগ্য। আপনি বসুন। আমি সক্কলকে খবর দিই।’ বিপ্র গুনগুন করতে লাগল:
আরে বল হাওয়াতে কইছে কথা
মন আলেকলতা।
দেখতে দেখতে বিপ্রদাসের দাওয়া ভরে উঠল বলরামীদের ভিড়ে। দাওয়ায় জায়গা তার আঁটে না। মুড়ি চা খেতে খেতে আলাপ চলল। সবচেয়ে বয়স্ক ভক্ত পূর্ণ হালদার এসে দণ্ডবৎ করে বসল। খবর পেয়ে গ্রামের ব্রাহ্মণ এক মাস্টারমশাই এসে তাঁর পরিচয় দিয়ে আমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাড়ি মধ্যাহ্নভোজের। বাধা দিয়ে বিপ্র বলল, ‘বলেন কী? উনি মেহেরপুর ফেরত লোক, একেবারে খোদ হাড়িরামের অতিথা কারিকর ওঁর জন্যে ইয়া বড় একখানা মাছ পেটিয়েছেন। তা ছাড়া ওঁর আপ্তজ্ঞান হয়েছে। জাত বিচার করেন না।’ বলেই হাত বিপ্র গাইল।
আমার হাড়িরামের চরণ কৃপায় মিলে সব জাতে।
ও তার শুদ্ধ আচার সত্যবিচার দেখলাম সাধুসঙ্গেতে ॥
তব জলে পাক অন্ন ভেদ নাই ছত্তিশ বন্ন
এ সংসারে আর কে পারে হাড়িরাম ভিন্ন?
দারুণ সুরেলা গলা। তালমানের জ্ঞানটুকুও পাকা। অবাক হয়ে বলতেই হল: কথায় কথায় তোমার এখন গান এল কেমন করে? গলাখানাও তো চমৎকার বানিয়েছ!
বিপ্রদাস জিভ কেটে সংশোধন করল, ‘আবার ভুল করলেন বাবুমশাই, সবই কারিকরের খেল। আর গানের কথা বলছেন? সেটা বলার মতো। কী বলো হে তোমরা। আমার বাড়িতে ধানের গোলা নেই বটে, নেতান্ত গরিবগুরবো জেলে, তবে এ আমার গানের গোলাবাড়ি’, একটা বিকট হেসে বিপ্র বলল, ‘চোপর রাত ধরে আমি হাড়িরামের গান গাইব। ও আপনার টেপ রেকর্ডার যন্তরের ফিতে শেষ হয়ে যাবে তবু আমার গান শেষ হবে না। না কি বলল তোমরা!’
সকলে সানন্দে সায় দিল। পূর্ণ হালদার বলল; আর তোর স্মরণশক্তির কথাটা বল।
খুব সায় দিয়ে গোঁফ মুচড়ে বিপ্রদাস বলল: সেটাও কারিকরের অদ্ভুত কৃপা আমার পর। কোনও জিনিস আমার বিস্মরণে নাই। লেখাপড়া বেশি জানি না, এই ফোর পাশ, কিন্তু হাড়িরামের সব তত্ত্ব আর দীন গোষ্ঠ সদানন্দর সব গান আমার অন্তরে লেগে আছে। তবে কতদিন থাকবে জানিনে আর আমি চলে গেলে যে এ সব গান কে গাইবে কে জানে! এ ছোঁড়াগুলোর আসনাই বেশি, নিষ্ঠা কম। দেখি, কারিকর কাকে শেখাতে আদেশ করে। আপাতক তো আপনার যন্তরে বন্দি করা থাক। একটা হদিশ থাকবে। বিকেলে আরশিগঞ্জ থেকে আমাদের আরেক গাহকের আসার কথা। দেখি। যদি আসে। সে ব্যাটা বোধিতনে পড়ে আছে তো? কথা রাখতে পারে না।