বলরামীদের সাধনা আবার ওই অনুমান-বর্তমানেরও বাইরে আরেক রকমের। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে সাহেবনগরের ফণী দরবেশ আমাকে বলেছিলেন: ও সব রাধাকৃষ্ণ দুর্গাকালী আমরা ভজি না। আমরা বলি—‘যাহা দেখি নি নয়নে/তাহা ভজিব কেমনে?’ তাই আমরা হাড়িরামকে ডাকি। তাঁরই জন্যে কাঁদি। মানুষটা তো আমাদের জন্যেই মানুষরূপে জন্ম নিয়েছিল, না কি বলেন বাবু?
কিন্তু মেহেরপুরের সঙ্গে তেহট্টের নিশ্চিনপুরের যোগাযোগ ঘটল কেমন করে? আসলে আগেকার দিনে নদীয়া যখন ভাগ হয়নি তখন মেহেরপুর ছিল একটা মহকুমা শহর। আশপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে কেনা বেচা বা মামলা মকদ্দমার কাজে মেহেরপুর আসত মানুষজন। এই রকম কোনও কাজে নিশ্চিনপুরের তনু মণ্ডল সেখানে এসেছিল একবার। নেহাতই দৈবঘটনায় তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বলরামের। বলরামের বাক্পটুতা, ঐশীক্ষমতা আর ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে তনু তাঁর শিষ্যত্ব নেয়। এই তনু থেকেই নিশ্চিনপুরে বলরাম-ভজনার শুরু। আস্তে আস্তে ওই গাঁয়ের মৎস্যজীবী নমঃশূদ্ররা বলরামভজা হয়ে ওঠে। তনুর নির্বন্ধে মেহেরপুর থেকে হাঁটাপথে বলরাম বোধহয় নিশ্চিনপুরে আসেনও কবার। সেখানে তাঁর কাছে সরাসরি দীক্ষা নেয় মহীন্দর, রামচন্দ্র দাস, জলধর, সদানন্দ, শ্ৰীমন্ত আর রাজু ফকির। মেয়েদের মধ্যে দীক্ষা নেয় নটু, দক্ষ আর জগো। দেখতে দেখতে ধরমপুর, সাহেবনগর, আরশিগঞ্জ, নাটনা, ধা’পাড়া, হাউলিয়া, গরিবপুর, পলাশীপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে বলা হাড়ির মত।
এরা নিজেদের প্রচ্ছন্ন রেখে ধর্মসাধনা করত। কেননা সমাজে এরা ছিল অন্তেবাসী আর মরা গরিব। তা ছাড়া বৈষ্ণব আর সহজিয়ারা বলরামীদের দেখত খারাপ চোখে। বলরাম ভজন ব্যাপারটা তাদের বরদাস্ত হত না, কেননা তারা ছিল অবতারবাদী। কুবির গোঁসাই তাঁর গানে লিখেছেন: ‘বলরামের চেলার মতো/ কৃষ্ণকথা লাগে তেতো।’ বোঝাই যাচ্ছে, সাহেবধনীরা বলরামীদের খাতির করত না।
অবশ্য তাতে বলরামের কিছু এসে যায় নি। তাঁর জীবিতকালেই তো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর মতাদর্শ। তাঁকে সবাই বলত ‘বাচক’। তার মানে তাঁর ছিল অসাধারণ বাকচাতুর্য এবং জগৎ ও জীবনের নানা বিষয়ের তিনি নিগূঢ় ব্যাখ্যা করতে পারতেন। সমস্ত শিষ্যকে সম্মিলিত করে তিনি বছরে তিনবার মহোৎসব করতেন। চৈত্র একাদশীতে বারুণী, জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি আর কার্তিকী একাদশী। তার মধ্যে বারুণীতে জাঁক হত বেশি। শিষ্যরা বলরামকে দোলমঞ্চে বসিয়ে আবির খেলত। ১২৯৭ বঙ্গাব্দে ৩০ অগ্রহায়ণ (১৮৯০) বলরাম মারা যান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যুর পরও বলরামভজাদের রমরমা কিছুমাত্র কমেনি। কিন্তু দেশবিভাগের ফলে এ সম্প্রদায়ের মানুজন নানাস্থানী হয়ে পড়ে। তবু নিশ্চিন্তপুরে এখনও এদের বড় ঘাঁটি। সেখানে পালাপার্বণ আর বেলতলার নিত্যপূজা একভাবেই চলছে। সে গ্রামে অনেক মানুষই বলরামভজা।
এ সব খবর আমি আগেই জোগাড় করে নিই সাহেবনগরের ফণী দরবেশের কাছে। মানুষটা বড় নরম। শুধু একগাদা সন্তান হয়ে একেবারে মুষড়ে পড়েছে। কেবলই খেদ করে আর বলে, ‘কারিকর এ আমার তুমি কী করলে!’
ফণী দরবেশ আমাকে ঠেলে পাঠাল নিশ্চিন্তপরের দিকে।
১ নম্বর তেহট্ট ব্লকের অন্তর্গত ৫২ নম্বর মৌজা, পোশাকি নাম নিশ্চিন্তপুর। লোকের মুখে মুখে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিনপুর। খুব নিশ্চিন্ত জায়গা অবশ্য নয় প্রশাসনের পক্ষে। গ্রামে ঢোকার আগে ব্লক আপিসের একজন বললেন: খুব সাবধানে ঘোরাফেরা করবেন। এককালে গ্রামটা ছিল টেরর। ডাকাতে ভর্তি। ও আপনার যতই বলরামী-ফলরামী হোক, সাবধানের মার নেই।
আমি অবশ্য অকুতোভয়ে গ্রামে ঢুকলাম। মনে মনে জপতে লাগলাম: মেহেরপুরের বেন্দাবন আমাকে পাঠাচ্ছে ভক্ত্যা রাধারাণী সকাশে। আমার তা হলে ভয় কোথায়?
*
মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে পাটকেবাড়ির বাস এক পাকুড়গাছ তলায় দম ছাড়ল। কনডাক্টর হাঁক পাড়ল: নেমে পড়ুন—নিশ্চিনপুর।
অন্তত আধঘণ্টা মেঠো পথে হেঁটে তবে গ্রাম। হদিশ নিয়ে প্রথমে গেলাম বেলতলায় রাধারাণীর কাছে। পরিচয় পেয়ে সে সমাদর করে বসাল। সত্যিই দেখবার মতো বিশাল বেলগাছ। তার একটা বড় ডাল ঝুলে পড়েছে। একেবারে পড়ো-পড়ো। তাই ইটের গাঁথনি দিয়ে ডালটাকে ঠেকিয়েছে। আদ্যিকালের লক্ষণযুক্ত বেলগাছ। এখানে হাড়িরাম এসেছেন কত! তাই পবিত্র। গাছের গুঁড়ির কাছে ভক্তিভরে রাখা আছে হাড়িরামের একজোড়া খড়ম। রাধারাণী এগিয়ে এসে বলল: কী দেখচো ছেলে, হাড়িরামের ছিচরণের খড়মজোড়া? দ্যাখো ভক্তি করে। রোজ বেলা বারোটায় এই খড়মজোড়া তেলে জলে ছ্যান করাতে হয়। সরকারের সেইরকম হুকুম।
: সরকার মানে গভরমেন্ট?
: না গো ছেলে। সরকার আমাদের প্রধান। ধা’পাড়ায় থাকেন। চারুপদ নাম।
: তা খড়মজোড়া স্নান কে করায়?
: আমিই করি? তেনার সেবাপুজোর ভার এখন আমাতেই বত্তেছে। আমি চোপর দিন রাত এখানেই থাকি। আমার ভাগ্য।
: হাড়িরামের ভোগরাগ কী দিয়ে হয়?
: ওঁর সেবায় সেদ্ধপক্ক ভোগ চলে না। শুধু কাঁচাভোগ। মুগের ডাল ভেজানো, ফল আর আখের বা খেজুরের গুড়। দোকানের পাক দেওয়া সন্দেশ রসগোল্লা চলে না।
: পুজোর বা ভোগরাগ নিবেদনের কোনও নিয়ম বা মন্ত্র আছে?
: ভোগরাগ এই বেলতলায় রেখে দুটো ফুল ফেলে তাঁর নাম করতে হয়। তিনি সেবা করেন। আর যখন চালজল সেবা দিই তখন বলতে হয়—