দিব্যযুগে যে হাড়িরাম
মেহেরপুরে তার নিত্যধাম ॥
লক্ষ করলাম, বলা হাড়ি ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র বা দ্বাপরের বলরামের অবতার বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি। নিজেকে বসিয়েছেন এ সবের ঊর্ধ্বে। নিজের নাম দিয়েছেন ‘রামদীন’। রামদীন মানে কী?
বৃন্দাবন গাইতে লাগল:
‘রা’ শব্দে পৃথিবী বোঝায়
‘ম’ শব্দে জীবের আশ্রয়।
‘দীন’ শব্দে দীপ্তাকার হয়
নামটি স্মরণ করলে তার॥
জানতে চাই বলরামীরা কার পুজো করে। কাউকে তো তারা ডাকে? উপাস্য তো কেউ আছে? সে কে?
বৃন্দাবন বলে: আমরা কোনও ঠাকুর দেবতা, কোনও মূর্তি বা ছবি কি কোনও ঢিবি বা গাছকে পূজি না আজ্ঞে। আমরা কাউকে প্রণাম করিনে। আমরা শুধু রামদীনকে ডাকি। তিনিই তো কারিকর। সদানন্দ নিকেছে—
হাড়িরামতত্ত্ব নিগূঢ় অর্থ বেদবেদান্ত ছাড়া।
করে সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্য সেই পেয়েছে ধরা।
এই তত্ত্ব জেনে শিব শ্মশানবাসী।
এই তত্ত্ব জেনে শচীর গোরা নিমাই সন্ন্যাসী ॥
যেন অলীক সব কথাবার্তা। কিমাকার সব বিশ্বাস। দেখতে দেখতে সূর্য ঢলে পড়ে বলরামের মন্দিরের পশ্চিমে। আমার চোখে পড়ে মন্দিরের একটা সিল্যুট। চারিদিকে ভক্ত নরনারী। তাদের চোখে মুখে স্থির বিশ্বাসের দৃষ্টি। গর্বোজ্জ্বল মুগ্ধতা। মেহেরপুরের জনসমাজের একেবারে পরিত্যক্ত অংশে এই মালোপাড়া। গাছগাছালির জঙ্গল আর মরা গরিবদের ভাঙা বাড়ির হতশ্রী। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বৃন্দাবন হেঁকে বলতে লাগল: আপনারা যাদের ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বলেন, তেনাদেরও সৃষ্টি হাড়িরাম হতে।
: বলো কী? কীভাবে তা হল?
: দেখুন, আমরা বিশ্বাস করি যে হাড়িরামের হাই হতেই হৈমবতীর সৃষ্টি। সেই হৈমবতী হতেই ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর। ঠিক কিনা বলুন?
ভৈরব তীরে রাত নামল। মনে মনে প্রণতি জানিয়ে বিদায় নিলাম হাড়িরামের মন্দির চত্বর থেকে। মনে বিস্ময় আর সন্ত্রম। বৃন্দাবনকে জিজ্ঞেস করলাম: হাড়িরাম সম্পর্কে আরও অনেক কথা জানতে ইচ্ছে করছে। আর কোথায় যাব?
হতাশ ভঙ্গিতে বৃন্দাবন বললে: দেশ ভাগ হয়ে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে আজ্ঞে। তবে আপনাদের ওপারে নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নিশ্চিন্তপুরে যদি যান তবে অনেক খবর পাবেন। সেখানে সিদ্ধপীঠ বেলতলায় হাড়িরামের খড়ম জোড়া আছে। তাতে নিত্য তেলজল দেয় রাধারাণী। তাকে গিয়ে আমার কথা বলবেন। বলবেন, মেহেরপুরের বেন্দাবন পেটিয়েছে আপনারে। আর ওই নিশ্চিনপুরেই আছে পূর্ণ হালদার, বিপ্রদাস হালদার। দুজনেই বুড়ো হয়েছে। তবে বিপ্র ডাঁটো আছে এখনও। হাড়িরামের অনেক গান সে জানে। শুনে নেবেন। তা ছাড়া ধা’পাড়ায় আছে আমাদের এখানকার ‘সরকার’ চারু। সাহেবনগরে আছে ফণী দরবেশ। বাবু, যাবেন কিন্তু অবশ্যই।
*
পাঠকদের নিশ্চিন্তপুরে নিয়ে গিয়ে বলরামীদের মুখোমুখি করার আগে বরং হাজির করা যাক আরও কয়েকটা জরুরি অনুষঙ্গ। মানুষজন ব্যাপারটি কী? মেহেরপুরের সঙ্গে নিশ্চিন্তপুরের যোগাযোগ হল কবে, কেমন করে? বলরামীদের সাধনা কী ধরনের?
আর পাঁচটা উপাসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বলরামীদের খুব একটা মিল নেই। গুরুবাদে এরা বিশ্বাসী নয়, কাজেই মন্ত্রদীক্ষা বা শিক্ষা নেই। সহজিয়া বৈষ্ণবদের মতো প্রবর্ত-সাধক-সিদ্ধ এসব স্তরপরম্পরার সাধনমার্গ এদের নেই। বেশির ভাগ লৌকিক সাধনার যা সামান্য লক্ষণ, অর্থাৎ নারীসঙ্গী নিয়ে কায়াসাধন তা এরা করে না। তাই এ ধর্মে বিকৃতি কম। গুরুবাদ নেই বলে ভক্তের উপর শোষণ কম। এদের ধর্মের আচরণবিধি খুব সহজ সরল। সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের কেউ নেই। একেবারে নিম্নবর্ণের হিন্দু, অন্ত্যজ ব্রাত্য সব মানুষ আর কিছু দলছুট মুসলমান এদের দলের অংশীদার। মুসলমান থেকে বলরামী হয়েছে যারা, তারা হাড়িরামকে বলে হাড়িআল্লা। এদের মুরুব্বিদের অত্যাচার নেই, উচ্চবর্ণ, গুরু নেই। তাই গদি নেই, খাজনা নেই, মন্ত্রতন্ত্রের অভিচার নেই, আখড়া নেই, আসন নেই। আসন মোট দু’জায়গায়। এ বাংলায় নিশ্চিন্তপুর, ও বাংলায় মেহেরপুর। আলখাল্লা, জপমালা, তসবি বা খেলকা এদের নেই।
আসলে বলরামীরা মানুষভজনে বিশ্বাসী। মানুষ, তাদের মতে, কারিকর হাড়িরামের সৃষ্টি। ঈশ্বরের নয়। সংসারে থেকে এ ধর্মের সাধনা করতে হয়। এরা মনে করে, হাড়িরাম যেমন আঠারো তত্ত্ব দিয়ে মানবদেহ গঠন করেছেন, তেমনই সেই দেহ চালাচ্ছেন তিনি। একটা গানে বলছে:
হাড়িরাম কলমিস্তিরি হেকমতে চালাচ্ছে এ কল।
আর একটি গানে রয়েছে:
হাড়িরাম মানবদেহ বানিয়েছে এক আজব কল।
বলের সৃষ্টি বলে করায় মন আমার
বল বিনে চলবে না কল।
এখানে ‘বল্’ মানে রক্ত।
যদিও এরা অবতারবাদে বিশ্বাসী নয়, তবু সম্ভবত বৈষ্ণব ভাবাপন্নদের মনে প্রতীতি আনার জন্য তারা বলে: ‘নবদ্বীপে এসে ছিন্নবেশে কেঁদে গেল শচীর গোরা’ এবং তারই পরিপূরকভাবে কলিকালে মেহেরপুরে পূর্ণমানুষ দ্যাখ সে তোরা।’ আবার মুসলমানদের মনে হাড়িরাম সম্পর্কে প্রতীতি আনতে গায়
অসম্ভবে কথা শুনে লাগলো জীবের দিশে।
আল্লাতালা মেহেরাজে মানুষরূপে আসে ॥
কিন্তু কেন এই ব্যক্তিভজন? কেন এমন করে একজন মানুষকে দাঁড় করাবার চেষ্টা?
আসলে বাঙালির লৌকিক ধর্মসাধনার দুই রূপ; অনুমান আর বর্তমান। লৌকিক সাধক বলেন: রাধা-কৃষ্ণ-বৃন্দাবন-মথুরা-কুব্জা-কংস-চন্দ্রাবলী এ সব কল্পনায় অনুমান করে যে সাধনা তাকে বলে অনুমানের সাধনা। আর বর্তমানের সাধনা হল মানবদেহ নিয়ে। সেই দেহেই আছে বৃন্দাবন, সেখানেই মান-বিরহ-বিপ্রলম্ভ-শৃঙ্গার। মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে গুরুর নির্দেশিত পথে দেহতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে যুগলভজনে যে ঐশী উপলব্ধি সেটাই সঠিক পথ।