সামনের সবচেয়ে ছোট্ট ছেলেটি বলে উঠল, ‘বাবা মরে গেছে।’
: সে কী? কবে? কী ভাবে? এই যে পরশু তাঁর চিঠি পেলাম?
অঝোর কান্নায় ঢলে পড়ল আমার পায়ে এক অসহায় স্ত্রীলোক। তারপরে চোখ মুছে বলল, ‘উনি দেহ রেখেছেন কার্তিক মাসে। টি. বি. হয়েছিল তিন বচ্ছর, চিকিচ্ছে করাননি। অপরাধ নেবেন না বাবা। চিঠিখানা আমিই লিখিয়েছি ধম্মো ভাইকে দিয়ে।’ একটু থেমে বলল, ‘মরণের খবরটা আপনাকে দিইনি, তা হলে তো আসতেন না। বাবা, আমরা বড্ড গরিব অসহায়। টাকাটা পাব তো? সব খাতা নিয়ে যান।’
এখন যখন মাঝে মাঝে কুবির গোঁসাইয়ের গানের খাতা খুলি, মনে পড়ে ভেঙে পড়া দীনদয়ালের ঘর, ক্ষীয়মাণ এক ধর্মসম্প্রদায়ের করুণ আত্মনিঃশেষ। যখন যাদুবিন্দুর গান পড়ি তখন চোখের সামনে ভাসে বেহুঁশ জ্বরে আরক্ত দেবেন গোঁসাইয়ের ম্লান মুখ আর সেই সঙ্গে নারীকণ্ঠে কানে বাজে; ‘মরণের খবরটা আপনাকে দিইনি, তা হলে তো আসতেন না।’ খুব সত্যি কথা।
*
এবারে একেবারে আলাদা রকমের ব্যাপার। উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি একটা সময়। আশ্বিন মাসে পিতৃপুরুষের নামে তর্পণ করছেন ব্রাহ্মণরা। জায়গাটা হল অবিভক্ত বাংলার মেহেরপুরের ভৈরব নদী। অঞ্জলি ভরে নদীর জল নিয়ে পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে ব্রাহ্মণরা ভক্তিনতচিত্তে পিতৃপুরুষের ধ্যান করতে করতে হঠাৎ দেখেন অনতিদূরে বুকজলে দাঁড়িয়ে একজন অন্ত্যজ মানুষ তর্পণ করছে। ভাল করে নিরিখ করে তাঁরা চিনতে পারলেন মালোপাড়ার বলরাম হাড়িকে। কী স্পর্ধা! গলায় পরিহাসের সুর মিলিয়ে একজন বলে উঠলেন: কী রে বলা, তোরাও কি আজকাল আমাদের মতো পিতৃতর্পণ করচিস্ নাকি?
কিছুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে বলা হাড়ি জবাব দিলে: আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই, আমি আমার শাকের ক্ষেতে জলসেচ করচি।
বিস্মিত ব্রাহ্মণ বললেন: বলিস কী? এখানকার জল তোর জমিতে যাচ্ছে কী করে? আকাশ দিয়ে নাকি?
বলরামের সপ্রতিভ জবাব: আপনাদের তর্পণের জল কী করে পিতৃপুরুষের কাছে যাচ্ছে আজ্ঞে? আকাশ দিয়ে? বুঝলেন ঠাকুরমশায়, আপনাদের জল যেমন করে পিতৃপুরুষরা পাচ্ছেন আমার জলও তেমনি করে জমিনে যাচ্ছে।
মুহূর্তে আবহাওয়া থমথমে। অপমানিত ব্রাহ্মণরা বলরামের দিকে বিষদৃষ্টি হেনে চলে গেলেন। ছোটলোকের এত বড় আস্পর্ধা? ব্যঙ্গের হাসিতে দর্পিত মুখখানা ভরিয়ে বলরাম হাড়িও বাড়ির পথ ধরল।
কে এই বলরাম? কেন তার এহেন প্রতিবাদ? উচ্চবর্ণের প্রতি কীসের তার এত ক্রোধ?
উনিশ শতকের নদীয়া জেলার মেহেরপুর। ছোট শহরের পশ্চিমদিকে অন্ত্যজ শ্রেণীর বসবাস। সেখানে মালোপাড়ায় জন্মেছিল বলরাম ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। বাবা গোবিন্দ হাড়ি, মা গৌরমণি। সেকালে হাড়িদের জীবিকা ছিল শুয়োর চরানো, গাছগাছড়ার ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি কিংবা বড়লোকের দারোয়ানি। বলরাম ছিল মেহেরপুরের বিখ্যাত ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। হঠাৎ একরাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সমস্ত অলংকার গেল চুরি হয়ে। সন্দেহ পড়ল বলরামের ওপর। তাকে গাছে বেঁধে প্রচণ্ড প্রহার চলল। শেষপর্যন্ত সকলের পরামর্শে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল তাকে। এই ঘটনায় বৈরাগ্য এসে গেল বলার মনে। ছিঃ এত নিচু মানুষের মন? নিচু জাতি বলে বড়লোকদের এত ঘেন্না? সহসা তার মধ্যে জন্ম নিল এক প্রতিবাদী মানুষ। এই অসহায় জীবন, সমাজের এই অন্যায়, বিশ্বাসের এই স্খলন তাকে টলিয়ে দিল।
বেশ কবছর পরে আবার যখন মেহেরপুরে ফিরে এল বলরাম তখন একেবারে অন্য মানুষ। জটাজূটসমাযুক্ত, সাত্ত্বিক চেহারার সাধকের মধ্যে কোথায় সেই পুরনো ‘বলা’? ভৈরব নদীর ধারে তৈরি করল আসন। ইতিমধ্যে অলংকার চোর ধরা পড়েছিল। তাই অনুতপ্ত মল্লিকমশাই দিলেন জমি আর অর্থ। গড়ে উঠল মন্দির। তারপরে দলে দলে দীর্ঘদিনের ব্রাহ্মণশোষিত অন্ত্যজ মানুষ—কৈবর্ত, বেদে, বাগদি, নমঃশূদ্ররা এসে বলরামের কাছে শরণ নিল। বলরাম হল তাদের পরিত্রাতা। তৈরি হল এক নতুন ধর্মমত আর বিশ্বাস। চলতি কথায় তাকে বলে ‘বলা হাড়ির মত’। দেখতে দেখতে বিশ হাজার ভক্তশিষ্য জমে গেল। বলরামের সাধনসঙ্গিনী হল ব্রহ্ম মালোনী।
একশো বছরেরও আগে লেখা অক্ষয়কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইয়ে হাড়ি সম্প্রদায় সম্পর্কে অনেকটা খবর মেলে। তার চেয়ে বেশি খবর আছে পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘Hindu Castes and Sects’ বইতে। তিনি ১৮৯২-এ মেহেরপুর গিয়ে বলরামের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নানা কথা বলেছিলেন। বলরামের স্ত্রী প্রথমেই যোগেন্দ্রনাথকে তাঁর জাতি পরিচয় দিতে বলেন। তাদের ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষের কথা আগেই জানা ছিল বলে যোগেন্দ্রনাথ বলেন, তিনি মানুষ। তখন মহিলা তাকে বসতে বলে এবং এমনকী জাতে হাড়ি হয়েও অন্নগ্রহণে আহ্বান করে। বিস্মিত যোগেন্দ্রনাথ অবশ্য তাতে রাজি হন না, তবে মুগ্ধ হন সেই অশিক্ষিত মহিলার অনর্গল বাক্পটুতায় ও নেতৃত্বে। তাঁর মতে বলরামী সম্প্রদায়ের কোনও বিশেষ ধর্মীয় চিহ্ন বা বেশবাস ছিল না। তাদের অনেকে ছিল ভিক্ষাজীবী। আর একটা জিনিস তিনি লক্ষ করেছিলেন, তারা কখনওই কোনও ঠাকুর দেবতার নাম উচ্চারণ করে না। তবে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই ধর্মের, যা তাঁর মনে হয়েছিল, তা হল, ব্রাহ্মণবিদ্বেষ। ব্যাপারটা তিনি এইভাবে লিখেছেন: