‘দাঁড়াও দাঁড়াও আমি মনোরঞ্জনকে বোঝাতে চাই, ‘না হয় দেওয়া গেল। তাতে পার্মানেন্ট সলিউশন কি হবে? দশ টাকা ফুরোলে তারপর? এ গাঁয়ে পচা নামে তিনজন আছে, কিন্তু পচার মতো অভাবী লোক আছে অনেক।’ মনোরঞ্জনকে খানিকটা চাঙ্গা করবার জন্যে বললাম, ‘ডাকো ওকে। কিছু জিজ্ঞেস করি।’
খুব নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে সে সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলের নখ দিয়ে মাটিতে চিত্তির আঁকতে লাগল। এদিকে বিকেল শেষ হয়ে আসছে। আমি খুব সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘পচা, কাল আর আজ দুদিনই তুমি দুপুরে স্নান করলে না, বাড়ি গেলে না। কেন?’
: ছ্যান করলে খিদে পায় বড্ড। বাড়ি যাই না, খাব কী? বাচ্চারা খিদেয় কাঁদে, বউ গালমন্দ করে। সইতে পারি না। তাই পেলিয়ে পেলিয়ে বেড়াই।
: কটা ছেলেমেয়ে তোমার?
: দুটো। একটা ছেলে একটা মেয়ে।
মনের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের পোস্টার আর লোগো ভেসে ওঠে। হাসিমুখ বাবা-মা বালক আর বালিকার প্রতীকী ছবি। সঙ্গে শ্লোগান ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’। মনের বাষ্পচ্ছন্নতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করি: ছেলেমেয়ে ইস্কুল পড়ে?
: পাউরুটির লোভে যায়। টিফিনে পেলিয়ে আসে।
: আজ সকালে তোমরা সকলে কী খেয়েছ?
: আজ্ঞে দীনদয়াল আজকে আধবাটি গমচুর সেদ্ধ মাপিয়েছেন।
: সারাদিন বসে আছ। খিদে পায় না?
: খিদে মরে গিয়ে নাড়ি হেজে যায়। তখন আর খিদে থাকে না দীনদয়ালের কৃপায়।
: এখানে গ্রামে কোনও কাজ নেই?
: গাঁয়ের নাম ঈশ্বরচন্দ্রপুর। কিন্তুক ঈশ্বরের নেকনজর নেই। এখানে কিষানের কাজ জুটলে কটা টাকা পাওয়া যায়, নিদেন গম। তা কই? এ বছর বড্ড অজন্মা। দীনদয়ালের ইচ্ছেয় এবারে ক্ষেতে ধান নেই।
: বাইরে মজুর খাটতে গেলে পার?
: আশপাশের গাঁয়ে সেখানকার কিষান মুনিষই কাজ পায় না। পেত্যেকবার বারাসাতের দিকে ধান কাটতে যাই আমরা কজন। পাই কটা টাকা আর দিনেরাতে তিনবার ভরপেট খাওয়া। মাস দুইয়ের কাজ। যে কাঁচা টাকা জমে তাতে সোম্বচ্ছরের কাপড়-জামা কিনি, ছেলেমেয়েদের মিষ্টি কিনে দিই একদিন। অগ্রদ্বীপের মেলায় যাই জরিমানা দিতে। এবারে এখনও বারাসতের খবর আসে নি। উঠি বাবুদ্বয়, কথায় কথা বাড়ে।
মনোরন বলল: ‘এখন কোথায় যাবে?’
এতক্ষণ পর সারাদিনের শেষে সমস্ত মুখ ভরিয়ে হেসে ঘা-পচা বলল: ‘দেখছেন না বাবু, দীনদয়ালের কৃপায় আজকের দিনটা কেটে এয়েছে। আর এটুখানি পরে সন্ধে পিদিম জ্বলবে। আমি এবার মৌজ করে একডা ডুব দেব নদীতে। তারপরে একছুটে বাড়ি।’
: বাড়ি গিয়ে কী করবে?
‘পেরথমে খানিকটা ঝাঁটা-লাথি মুখখিস্তি করবে পরিবার’ লাজুক হাসল পচা, ‘তার কোনও দোষ নেই। সারাদিন বনে-বাদাড়ে কন্দ কচু খোঁজে, লোকে হেনস্থা করে। ছেলেমেয়ে দুটো কমনে থেকে আনে গেঁড়ি-গুগলি। হয়তো কার কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বউ এনেছে এড্ডু চাল। ওই সব মিলিয়ে একটু পঞ্চতত্ত্ব সেবা হবে। দীনদয়াল যেমন দ্যান। সেই সেদ্ধ ঘ্যাঁট খানিক খেয়ে একটা তোফা ঘুম দেব। এক ঘুমে সকাল।’
: কাল সকালে কী হবে?
: তা জানেন দীনদয়াল। কিছু না হয় তো এই বাঁশের মাচান আছে। কোনওরকমে সন্ধে অবধি কাটিয়ে দিলেই হবে। যাই গা তুলি, জয় দীনদয়াল দীনবন্ধু।
অপসৃয়মাণ দিনের আলোর মতো পচা নেমে গেল নদীর ঘাটে। নেমে এল মনোরঞ্জনের থমথমে মুখের মতো সন্ধ্যা। আমি ভাবলাম, দীনদয়াল কোথায় থাকেন? হুদায় শরৎ পালের ভিটেয়, হরিমতী দিদির বিশ্বাসে না গণেশ বা পচার মতো মানুষের দুঃখের অতলে?
______