লম্বা জিভ কেটে গান থামিয়ে গণেশ বলল: এত বড় ভাবের গান আমি লিখতে পারি কখনও? অগ্রদ্বীপে ঈশুপ ফকিরের কাছে এ গান আমার শেখা। ভণিতে পাইনি, তবে গানের ভাবে মনে নেয় এ আমাদের যাদুবিন্দুর গান। বাকিটুকু শোনেন:
দুঃখু আমার মুক্তি গতি
দুঃখু আমার সঙ্গের সাথী
হৃদয়ে জ্বলে দুঃখের বাতি
দগ্ধ করে দিল জীবন।
আবার দুখের কথা রইল গাঁথা
করবে কে তা নিবারণ?
সত্যি বলতে কী, এমন একটা গান এ গ্রামে শুনতে পাব ভাবিনি। কোথায় যে কী মিলে যায়!
রাতে শোবার আগে গণেশ পাড়ুইয়ের সঙ্গে অনেক কথা হল। ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামে নাকি দীনদয়ালের একচেটিয়া ভক্ত। ‘বাবু, অগ্রদ্বীপের মেলায় আমাদের গ্রাম ঝেঁটিয়ে মানুষ যায়। সব দীনদয়ালের নামে মতিমান। এখানে মচ্ছব হয় ফাগুন মাসের দ্বিতীয়া তিথিতে। সামনের বার আসবেন বাবু সে সময়ে। ঈশুপ ফকিরের গান শোনাব। তাঁর গানে আমাদের খুব শান্তি হয়।’
পরদিন সকালে আমরা গিয়ে বসলাম ঈশ্বরচন্দ্রপুরের একপ্রান্তে জলাঙ্গী নদীর ধারে এক বটগাছতলার বাঁশের মাচায়। গ্রামদেশে গাছতলায় এমন বাঁশের মাচা থাকে, সেগুলো এজমালি। যার যখন দরকার বসে। আগের দিন এই মাচায় বসে অনেকক্ষণ ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রধান কাজ একেবারে সাধারণ পর্যায়ের সাহেবধনীদের নিয়ে। যারা দীনদয়ালকে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার ‘পঞ্চতত্ত্ব” অর্থাৎ চাল ডাল আর তিন রকম আনাজ দিয়ে খিচুড়ি পাকিয়ে নিবেদন করে। এরাই আসুনে ফকিরদের জরিমানা দেয়, সেবাপূজা করে। অগ্রদ্বীপে চরণ পালের থানে হত্যে দেয়। বলতে গেলে সাহেবধনীদের এরাই মূল জনশক্তি।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবলই আমার চোখ চলে যায় একজন শীর্ণ চেহারার মাঝবয়েসি লোকের দিকে। গতকাল থেকেই লোকটিকে একই জায়গায় দেখা যাচ্ছে। পরনে নীল লুঙ্গি আর ময়লা হেঁড়া গেঞ্জি। সারাদিন সামনের মাচায় নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে পা নাচায়। মুখখানা মলিন। চুলে অনেকদিন তেল পড়েনি। কোনও চাহিদা নেই, কোনও কৌতূহল নেই। চাহনিতে শুধুই শূন্যতা। কেউ হয়তো একটা বিড়ি দিল সেটাই টানল খানিকক্ষণ। যেন তাতেই খানিকটা সময় কেটে যাওয়ায় লোকটা খুব কৃতার্থ। সবাই ওকে খুব অবজ্ঞার সঙ্গে ‘পচা’ বলে উল্লেখ করে। যেন পচা লোকটা নিতান্ত উঞ্ছ উদ্বৃত্ত। জাতে নাকি দুলে। পচার গালে ভয়ানক এক আঁচড়ের দাগ। তাকে ডেকে সামনে বসানো গেল। খুব সংকুচিত ভঙ্গি তার। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পচা তোমার গালে ওই মস্তবড় দাগটা কীসের?’
‘আজ্ঞে, ওটা হল বাঘের আঁচড়’, খুব নির্বিকার জবাব।
: কী করে হল?
: তা বিশ-পঁচিশ বছর আগে পাশের গাঁয়ের জঙ্গলে বাঘ এয়েলো। শিকারিবাবু মাচান বেঁধে বসেছিল। আমরা দুলে বাগদিরা চার দিক থেকে জঙ্গল ঘিরে ক্যানেস্তারা টিন বাজাচ্ছিলাম। আমাদের বলত বিটার। খুব হইচই-চেঁচামেচিতে বাঘটা গেল হপকে। এলোমেলো ছুটে শিকারির দিকে না গিয়ে পড়ল এসে আমাদের দলের সামনে। তারপর বাঘমহাশয় দিলেন এক ইয়া লক্ষ্য। আমাদের টপকে পেলিয়ে যাবার সময় আমার গালে লাগল তেনার এক মোক্ষম আঁচড়। তাতেই দগদগে ঘা হয়েলো। তেমনি পুঁজ রক্ত। সদরের হাসপাতালে দু-দুটো মাস থাকত হয়েলো। দীনদয়ালের কিরপায় জানে বাঁচলাম। তবে দাগটা থেকে গেল আজ্ঞে। এ গাঁয়ে তো তিনজন পচা আছে। ‘তবলা পচা’ কিনা তবলা বাজায়, ‘মুদি পচা’ দোকানি, আর আমাকে সবাই বলে ‘ঘা পচা’।
এত নিস্পৃহ মানুষ যে কথা এগোনো মুশকিল। আমাদের কাজ চলে। পাড়াগাঁর দুপুরও এগোয়। শেষ ফাগুনের রোদ চনমনে হয়। আমাদের পেছনেই ঘাট। লোকজন সামনের ধারে খানিক এসে দাঁড়ায়, শোনে আমাদের কথা, তারপরে কোমরে গোঁজা বাঁশের পাত্র থেকে সরষের তেল মাথায় গায়ে চাপড়াতে চাপড়াতে ঘাটে নামে। খানিকটা জল উথালপাতাল করে স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে সপসপ্ শব্দ তুলে বাড়ি যায়। খানিক পরে তিনটে-চারটে নাগাদ সেই স্নাতভুক্ত মানুষজন একে দুইয়ে এসে জমে আমাদের মাচার কাছে। দেখে আমাদের কার্যকলাপ। তখন তাদের দেহ তৈলচিকণ, পরনে কাচা ধুতির মালকোঁচা। মুখে জ্বলন্ত বিড়ির মাদক। কিন্তু লক্ষ রাখি যে পচা তার মাচা থেকে ওঠে না। তার মানে স্নান করে না, খায় না। বেলা গড়ায়। আমাদের সঙ্গে পাঁউরুটি ডিমসেদ্ধ কলা। সকালে ফ্যানভাতে খেয়ে এসেছি কেননা দুপুরে গণেশের বাড়ি ফিরব না। সে গোয়াড়ি বাজারে কলা বেচতে গেছে।
আমাদের টিফিন খাওয়ার সময় হতে পচাকে ডেকে বললাম: ‘পাঁউরুটি কলা ডিম খাবে?’
‘দ্যান’ খুব অচঞ্চল ভঙ্গিতে নিয়ে মাচায় গিয়ে বসে খেল খুব তাড়াতাড়ি। সামনের টিউবওয়েলে জল খেয়ে আবার বসে পা দোলাতে লাগল।
ব্যাপার দেখে মনোরঞ্জন তার মাচায় গিয়ে বসে নিচুস্বরে খানিক কথা বলল। সে নাকি এমন মানুষ বেশি দেখেনি। দীনদয়ালের ব্যাপারে পচার কাছে আমার কিছু তথ্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয়নি। লোকটা একেবারে বিশেষত্বহীন, একঘেয়ে। কথা বলতেও উৎসাহ পায় না। ঘণ্টাখানিক পরে এসে মনোরঞ্জন উত্তেজনা চেপে আমাকে বলল: ‘জানেন স্যার, পচার কোনও জমি নেই, ফিক্সড ইনকাম নেই। লেখাপড়া জানে না। একখানা কুঁড়েঘরে থাকে, তার উত্তরকোণের চালা ভেঙে গেছে। ‘এবারে চোতের শেষে যদি দীনদয়াল দেন তবে খড় জোগাড় করে চালার ওইখেলাটা ছাইব’ এই কথা বলল। স্যার ওকে দশটা টাকা দেবেন?’