এখানে একটা সত্যি বলতে আপত্তি নেই যে টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরার চল যখন ছিল না তখনই অবশ্য ভাল কিছু কাজ এদেশে হয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেন বা নির্মলকুমার বস, মনসুরউদ্দীন, যোগেশ রায় বিদ্যানিধি, দীনেশচন্দ্র সেন কিছুকাল আগেও যত কাজ করে গেছেন এখন তার ধারে কাছে কেই বা যেতে পেরেছেন? অক্ষয়কুমার দত্ত, উইলসন সাহেব কিংবা যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতো খুব পুরনো লোকের কথা তুললে তো আরও লজ্জা লাগে।
আসলে খুব সমারোহ করে গেলে অনেক সময় ঠিক ঠিক জিনিস আদায় হয় না। ক্যামেরা রেকর্ডার এ সব দেখলে গ্রামের সাধারণ লোক খুব গুটিয়ে যায়। কারুর এ সবে ঘোরতর আপত্তিও থাকে। ফলে কখনও তারা কিছু বলে না বা ইচ্ছে করে ভুলভাল বলে দেয়। বৃত্তিহুদার শরৎ পাল আমাকে একবার একজন লোক-সংস্কৃতিবিদের কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আরে তিনি মশায় সবকিছু প্রমাণ রাখতে চান ফটো তুলে। আমার অত প্রমাণ রাখার দায়টা কী বলুন তো?’ একবার এক গ্রাম্যগুরুর কথায় খুব মজা পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার মতোই একজন এসেছিলেন সেবার। সঙ্গে এক মেয়েছেলে। তা সেই মেয়েছেলেটাকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে বলে কিনা “দাঁড়ান ফটো তুলব।” বুঝুন আস্পর্ধা। আমি বলে কখনও নিজের পরিবারকে নিয়েই ফটো তুলি নি তো কোথাকার কোন মেয়েছেলে। ছিঃ।’
এইসব দেখেশুনে ‘ক্ষেত্র গবেষণা’-র ব্যাপারে আমি খুব সাবধান সতর্ক থাকি। একটা সুবিধে আমার এই যে আমার কোনও দল নেই। একেবারে নিরম্বু একা। বড়জোর সঙ্গ দেবার জন্য জুটিয়ে নিই একজন খুব শান্ত ধরনের ছাত্রকে। যাতায়াতের পথে গল্প হয়। তার দেখার সঙ্গে আমার দেখাটা ঝালিয়ে নেওয়া যায়। কম বয়সের সুবাদে সে গ্রামের ছেলে ছোকরাদের কাছ থেকে বাড়তি কিছু খবর আনতেও পারে। সবচেয়ে বড় কথা গ্রামদেশে একা একা চলাফেরার কতকগুলো অসুবিধাও আছে, যদি না সে গ্রামটার মানুষজনের সঙ্গে আগে থেকে চেনাজানা থাকে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে ঈশ্বরচন্দ্রপুর যাবার সময় সঙ্গে নিয়েছিলাম মনোরঞ্জনকে। মূলত গ্রামের ছেলে। তার মানে কষ্টসহিষ্ণু, বেশ খানিকটা হাঁটতে পারে, মোটামুটি ডালভাতে সন্তুষ্ট। তা ছাড়া ‘বাথরুম কোথায়’, ‘স্নান করব কোনখানে’ বলে জ্বালাবে না। দিব্যি নদী বা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঈশ্বরচন্দ্রপুর খুব গরিবদের গ্রাম। সেখানে কামাল হোসেনের মতো দলিজ নেই।
ঈশ্বরচন্দ্রপুরে যার বাড়িতে আমরা উঠলাম তার নাম গণেশ পাড়ুই। গোয়াড়ির বাজারে সে চাঁপাকলা বেচে। সেই সুবাদেই আলাপ। আমি তার খদ্দের। তাকে সাহেবধনী বলে শনাক্ত করা অবশ্য নিতান্তই আমার কৃতিত্ব। একদিন তার কাছে খুব সুন্দর গাছে-পাকা কলা দেখে বলেছিলাম: ‘কী ব্যাপার, আজ তো কারবাইড পাকা নয়, এ যে গাছে পাকা!’
খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেছিল: ‘রোজ পাইকেরের কাছ থেকে কিনে এনে বেচি, আজ বাড়ির গাছের কাঁদি নামিয়ে এনেছি। সবই দীনদয়ালের কৃপা।’
দীনদয়ালের কৃপা? এই এক কোড ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে মানুষটাকে ধরে ফেলে বলি: ‘তুমি তা হলে হুদোর পালবাড়ির ঘরের শিষ্য? অগ্রদ্বীপ যাও, তাই না?’
কৃতাৰ্থ হেসে বলেছিল, ‘বাবুর তো তা হলে আমাদের ঘরের সবই জানা। একদিন আসুন আমাদের গ্রামে। ঈশ্বরচন্দ্রপুর, চেনেন তো? আমার নাম গণেশ পাড়ুই।’
গণেশ পাড়ুই মানুষটা খুবই গরিব। তবে নিঃসন্তান তাই হয়তো খুব অভাবী নয়। একখানা কুঁড়েঘর। তাতে বাঁশের মাচা। তাতেই শয্যা। ঘরের চত্বরে উনুন। রোদে ঝড়ে জলে সেখানেই কোনওরকমে দুটি ফুটিয়ে নেয় তার বউ। আজকে তার বাড়িতে উৎসব-বিশেষ। বউকে সে হেঁকে বলে: বাবুরা এয়েচেন। ডালটা এটু ঘন করে রাঁধো।’
ঈশ্বরচন্দ্রপুরে আমরা গবেষণার কাজে দু দিন দু রাত থাকব। তাই সব দিক বাঁচিয়ে সকালবেলা পৌঁছে গণেশের সম্মান রেখে সঙ্গে-আনা কিছু জিনিস নামিয়ে দিলাম ব্যাগ থেকে। আলু পেঁয়াজ ডিম চা চিনি গুঁড়ো দুধ পাঁউরুটি। ‘কিছু মনে করলে না তো?’ ‘সবই দীনদয়ালের খেলা, নইলে তিনি জানলেন কী করে যে আমার হাতে একটা পয়সাও নেই? অসুখ হয়ে দুদিন বাজারে যেতে পারি নি।’
সেদিন সারাদিন ধরে গ্রামের কাজ সেরে সন্ধে খানিকটা গড়িয়ে গেলে গণেশের বাড়ি ঢুকলাম। ততক্ষণে সে চাঙ্গা। চা মুড়ি খেয়ে উঠোনে বসেছি খেজুরপাটি বিছিয়ে। উঠোন থেকে ভাতের গন্ধ উঠছে। শুক্লপক্ষ চলছে বুঝি। আকাশে বেশ ভরাট চাঁদ। গণেশ একখানা একতারা এনে পিড়িং পিড়িং করতে লাগল। কী আর এমন গাইবে গণেশ। একখানা দুর্বোধ্য শহর-নাচানো ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ মার্কা গাইবে হয়তো। সে গান আবার থামবে তো? হঠাৎ গণেশ আমাকে চমকে দিয়ে গেয়ে উঠল:
আমি সুখের নাম শুনেছিলাম।
দেখি নাই তার রূপ কেমন।
আমার দুখনগরে বাটি পরিবার
দুঃখ রাজার বেটি
দুজনায় দুঃখে করি কালযাপন।
এ যে একেবারে আত্মজৈবনিক! এতখানি বিস্ময় আমার জন্যে দীনদয়াল রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রপুরের সন্ধ্যায়! গণেশ গেয়ে চলে যেন গভীর সন্তাপে আত্মস্থ হয়ে:
মনে করি সুখের দেশে
সুখী হয়ে থাকব বসে
দুঃখু বেটা তাড়িয়ে এসে
কেশে ধরে করে শাসন।
দুখের বেলা দুই প্রহরে
দুখের অন্ন করি ভোজন।
দুখের শয্যা পেতে সন্ধ্যাকালে
দুঃখেতে করি শয়ন ॥
মনোরঞ্জন ভাবল গানটা বোধহয় এখানেই শেষ। তাই উচ্ছ্বাসে বলে উঠল; আহা, কী গান। আমি এক্ষুনি লিখে নেব। এ তো আমাদের সকলের গান। এটা লিখেছে কে? তুমি?