সে রাতে ফকির দুপ্রহরে ডাকলেন। বললেন, ‘আর এক প্রহর পরে সেবা করে মৌনী হয়ে যাব, তার আগে আমাদের ঘরের কবচ তাবিজের খাতাখানা দেখাই। লণ্ঠনের আলোতেই দেখুন।’
সত্যিই অদ্ভুত আশ্চর্যজনক কতকগুলো কাগজের ছক। নানা রকমের চতুষ্কোণ আর শব্দ বা অক্ষর বা সংখ্যা। কোনও ছকের তলায় ‘বাণ কুজ্ঞান লাগে না। লাগিলে আরোগ্য হয়’, কোনটায় লেখা ‘তারকব্রহ্ম কবচ স্বপ্নদোষ নাশ হয়’, একটায় ‘স্বামী ভালবাসে’, একটায় ‘ঋতুরক্ষা হয়’। পানের আকারে আঁকা ছকে লেখা মায়াধরার কাগজ’, এমনকী দুখানা কবচের বিষয় ‘পিরিতি লাগে’ এবং ‘পিরিতি ছাড়ে’। তা ছাড়া অনেক মন্ত্র আর মাপের নির্দেশ।
ফকির বললেন, ‘এ সবও আমাদের ঘরের জিনিস। এককালে এ সব থেকে অনেক কঠিন রোগারোগ্য হয়েছে। সব স্বপ্নে পাওয়া। কাগজে লিখে তাবিজ করে পরতে হয়।’
: আপনি এ সব কবচ দেন?
: না। প্রয়োগ জানি না। শিখিনি। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। শিখিয়ে যেতে পারলেন কই?
: তার মানে এগুলোও বাতিল? শুধু কাগজের পুঁথি?
হতাশার দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল ফকিরের। কী আশ্চর্য মায়াময় মনে হল সমস্ত জগৎ! ওদিকে মেলায় হাজার হাজার বিশ্বাসী মানুষ পরম আশ্বাসে ঘুমোচ্ছে। ঘুম নেই শুধু তাদের গুরুবংশের প্রধান মানুষটার। তাঁর চিন্তা কেমন করে ভেঙে-পড়া দীনদয়ালের ভিটেটুকু বাঁচবে। কেমন করে আরও শিষ্য বাড়বে।
এক ঘুমে রাত কাবার। যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদের তেজ হয়েছে। বারুণীর স্নান চলছে গঙ্গায়। আজ ভাঙা মেলা। শরৎ বসেছেন মৌনী আসনে। গঙ্গা পেরিয়ে সোজা দুমাইল হেঁটে একেবারে অগ্রদ্বীপ স্টেশন। স্টেশনে গিয়ে দেখি সিমেন্টের বেঞ্চিতে অঘোরে পড়ে আছে ধুম জ্বরে দেবেন গোঁসাই। গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় হাত রাখি। ক্লিষ্ট হেসে গোঁসাই বলে: শেষ রাত থেকে এমনি জ্বর। ট্রেনে চেপে সমুদ্রগড় নেমে পাঁচলখি গিয়ে শয্যা নেব। মাথায় থাক আমার দীনদয়াল।
সাহেবধনী ঘরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমন করে যে গড়ে উঠল না তার কারণ আমারই শৈথিল্য। সত্যিই তো তাদের জন্যে কিছু করতে পারতাম না আমি। তবে বিশ্বাসভঙ্গ করিনি। শরৎ ফকির যতদিন জীবিত ছিলেন তাঁদের ঘরের গুপ্তকথা কাউকে বলিনি বা লিখিনি। হয়তো নিতান্ত হতাশায় কিংবা সুগভীর দুশ্চিন্তায় হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন তিনি। সে খবর পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওইখানেই এ অধ্যায়ের ইতি।
কিন্তু হঠাৎ দশ মাস পরে দিল্লির এক প্রতিষ্ঠান লোকসংগীত সংগ্রহের জন্য কিছু আর্থিক অনুদান পাঠাল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল দেবেন গোঁসাই আর তার কাছে সংরক্ষিত যাদুবিন্দুর খাতার কথা। পুরনো ডাইরির পাতা খুঁজে পাঁচলখির ঠিকানায় দেবেন গোঁসাইকে এক চিঠি পাঠালাম রিপ্লাই পোস্টকার্ডে। অভিজ্ঞতায় জেনেছি গ্রামের লোক অনেক সময় স্রেফ উদ্যমের অভাবে চিঠি লেখে না। তাই জবাবি চিঠি। তাতে দিন সময় জানিয়ে লিখে দিলাম আমার যাবার খবর। যেন এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে বাসস্টপে কেউ থাকে আমার জন্য। শ’পাঁচেক টাকা পাবার সম্ভাবনার কথাটুকুও ইঙ্গিতে লিখে দিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে একখানা চটের সাইড ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম। তার আগেই জবাবি-চিঠি এসে গেছে দেবেন গোঁসাইয়ের। তিনি লিখেছেন:
পূজনীয় দাদা,
আপনার একখানি পত্র পাইয়া সকল সমাচার অবগত হইলাম। আপনি যে আমার মতন হতভাগাকে মনে রেখেছেন এইটাই ধন্যবাদ। যাহা হউক, আপনি আমার এখানে ও পাঁচলখিতে আসার ইচ্ছুক, আমার সৌভাগ্য। দয়া করিয়া গরিবের বাড়িতে আসিবেন। আসিতে যেন কুণ্ঠিত হইবেন না। বাসস্টপে লোক থাকিবে জানিবেন। ইতি
আপনার হতভাগ্য দেবেনবাবু।
নবদ্বীপের হেমাইৎপুর, মোড় থেকে উঠেছি কালনা-চুপী রুটের বাসে। পৌষের শীতের বেলা এগারোটা। ভাবছি, খাতাগুলো পাব তো? আগে ভাগে টাকার কথাটা না লিখলেই হত। অবশ্য টাকাটা পেলে গোঁসাইয়ের অন্তত চিকিৎসা খানিকটা হবে।
‘নাদাই ব্রিজ ধোবা…বাবু নামবেন তো?’ কন্ডাকটার হাঁকে।
নামলাম। একটা বছর বারো বয়সের ছেলে এগিয়ে আসে তরতর পায়ে, ‘আমার সঙ্গে আসুন। আমাদের বাড়ি যাবেন তো?’
এক্কেবারে দেবেন গোঁসাইয়ের ছাঁচ। টানা টানা চোখ নাক। উজ্জ্বল রং। তাতে একপোঁচ দারিদ্র্যের ম্লানিমা। ‘তুমিই বড় ছেলে বুঝি? এত রোগা কেন?’
ছেলেটি জবাব দেয় না। তরতরিয়ে হাঁটে আগে আগে। কালো ইজের। ময়লা গেঞ্জি। মাথায় চাদর জড়ানো। গমক্ষেত পেরিয়ে, আলু ক্ষেতের পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। ছেলেটা বেশি কথা বলে না। হাঁ হুঁ দিয়ে চালায়। আমার প্রশ্ন তা বলে থামে না। ‘হ্যাঁরে, তোর বাবা এখন কালনা কোর্টে যায়?’ ছেলেটা মাথা হেলায়। ‘হ্যাঁরে, তোরা ক ভাই-বোন?’ আঙুল দিয়ে দেখায় পাঁচ। ‘দিদির বিয়ে হয়ে গেছে?’ মাথা নাড়ে। একনাগাড়ে মিনিট দশ হাঁটার পর হঠাৎ বলে, ‘ওই আমাদের বাড়ি।’ বলেই একদৌড়ে আমাকে ছেড়ে পালায় বাড়ির দিকে। একখানা মেটে ঘর, তাতে ভাঙা টালির ছাউনি। একটুখানি উঠোন। সন্ধ্যামণি আর গাঁদা ফুলের গাছ। ততক্ষণে আমার আসার সংবাদ পৌঁছে গেছে।
নিচু চালা। মানুষজনের পা দেখা যাচ্ছে। ‘কই দেবেনবাবু কই?’ হাঁক ছাড়ি। ছেলেটা জলের গাড়ু গামছা নিয়ে চট করে নেমে আসে, ‘পা ধুয়ে নিন।’ অপাঙ্গে দেখছি হতশ্রী দরিদ্র এক অপরিকল্পিত পরিবার। ধূলিধূসর দুটো রোগা ছেলে, দুটো মেয়ে আমাকে অবাক চোখে দেখছে। ময়লা শাড়ি পরা এক নতনেত্র মহিলা, নিশ্চয়ই দেবেন গোঁসাইয়ের স্ত্রী, নিচু হয়ে মেটে দাওয়ায় আমার জন্যে আসন পাতছেন। কিন্তু দেবেনবাবু কই? অস্বস্তি চাপতে না পেরে বলি: কোথায় গেলেন দেবেনবাবু?