পাশাপাশি আমি আর কামাল হোসেন খেতে বসলাম। দিদি বসলেন সামনে একখানা হাতপাখা নিয়ে। পরিবেশন করতে লাগলেন কামালের বিবি। গাঁ-ঘরের লজ্জাশীলা মহিলার মতো ঘোমটা টানা দুখানা মায়ালি চোখের বিস্ময় ঘোমটার ফাঁকে ধরা পড়ছিল। উনুনের আঁচের মতো উজ্জ্বল রং গরমের তাপে ফেটে পড়তে চাইছে যেন। চমৎকার স্বাদু রান্না। কামাল বারবার খুব তারিফ জানালেন। খেয়ে উঠে ভেতরের শোবার ঘরের বিছানায় বসলাম দুজনে। কামাল সিগারেট ধরিয়ে তাঁর বিবিকে ডাকলেন। সসংকোচে ঢুকে একপাশে দাঁড়ালেন অবগুণ্ঠনবতী। কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বিবির ঘোমটা খুলে দিয়ে বললেন, ‘জগতের আলো নুরজাঁহা। একদৌড়ে পালালেন বিবি তাঁর বিদ্যুৎ চোখের এক দারুণ দৃষ্টির বিপ্লব হেনে।।
হো হো করে প্রচণ্ড শব্দে হেসে কামাল বললেন, ‘সকালে আপনাকে বলা হয়নি, আমি আরও দুটো বিষয়ে অদ্বিতীয়। চারপাশের দশ-বিশখানা গাঁয়ের মধ্যে যত এলেমদার মুসলমান আছে তার মধ্যে একমাত্র আমার ঘরে দুটো নয় চারটে নয়, একখানা মাত্তর বিবি। আর দু নম্বর খবরটা হল আমাদের দুজনের বিয়ে ভাব-ভালবাসা করে।’
খুব তারিফ চোখে তাকালাম। তারপরে বললাম: ‘আপনার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ নাকি তার কম?
: তা পঞ্চাশই ধরুন। কেন?
: ভাবছি কতদিন আগে এই ভাব ভালবাসাটা হয়েছিল। তখন আপনার কত বয়স?
: সেসব কি মনে আছে? তবে এক কথায় শুনবেন? তখন আমার অনুরাগের বয়স।
ঘরের চৌকাঠের ওপারে কি একটা কাচের ঝাড়বাতি ভাঙল মধুর শব্দ করে? আসলে খিল খিল হেসে পায়ের মল চুটকি বাজিয়ে দৌড় লাগালেন অনুরাগিণী।
উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে কামাল বললেন, ‘জীবনটা এমনই খুব সুন্দর। মানুষও তো আসলে আনন্দেই বাঁচতে চায়। কিন্তু আজ ঘর আর বার আলাদা হয়ে গেছে। এমন যে সুখীসুন্দর মানুষটা আমি, বাইরে গেলেই ভোল পালটাতে হবে। বাজে কথা, সাজানো কথা, মন-রাখা কথা কইতে হবে। অথচ আমার রক্তে দর্জি ফকিরের হক্ রয়েছে। সে মানুষটা কপটতা জানত না। মারফতি ফকির তো?’
আমি বললাম: ‘এই শরিয়ত মারফত অনেকবার শুনেছি। একটু খোলসা করে বলুন তো তার কী তফাত?’
হরিমতী দিদি ঘরে ঢুকতে আমার কথাটা শুনেছিলেন। বললেন: ‘ও কী বলবে? ও তো জ্ঞানছাড়া। আমি বুঝিয়ে দিই। শরিয়ত হল কিনা গাছের গুঁড়ি। যদি ফল ফুল পেতে চাও তবে কি গুঁড়িতে পাবে? উঠতে হবে গাছের ডালে। মারফত হল গাছের ডাল ফল ফুল। শরিয়ত থেকেই মারফত। কিন্তু মারফত কবুল হলে শরিয়তের দাম কী?’
আমি এবারে কামাল হোসেনকে বললাম: ‘আপনার মতো মাতব্বর মুসলমান ব্যক্তির ঘরে যে হরিমতী দিদির মতো একজন খোদ হিন্দু বাস করেন তাতে ‘আপনাদের সমাজে আলোড়ন হয় না?’
: সত্যিই হয় না যে তার একটা কারণ দীনদয়ালের নামে আমাদের এ দিগরে সবাই ভক্তিমান। আমার বাবার আমল থেকে আমাদের বাড়িতে দীনদয়ালের নামে কত মান্সা, কত সিদে, সে আপনি ধারণা করতে পারবেন না। চোত মাসে মচ্ছবের সময়ে আমার এক পয়সা খরচ করতে হয় না। গাঁয়ের সমস্ত মানুষ চাল ডাল আনাজ তরি-তরকারি নিজেরাই আনে, এনে অন্ন মচ্ছব করে। হিন্দুই বলুন আর মুসলমানই বলুন এখানকার সাধারণ মানুষ দীনদয়ালের নামে এককাট্টা। তার ওপরে আছে আমার বুড়ি হরিমতী আপা। সারা এলাকায় খুব খাতির। তার কথায় সবাই এক পায়ে খাড়া। আসলে সারাজীবনে একটা ব্যাপার কী দেখলাম জানেন? ভাল জিনিসের মার নেই। এই যে আমার এত দালানকোঠা বারামখানা, দোকান, গমকল, পোস্ট অফিস, হেকিমি, পার্টিবাজি তবু আমাকে লোকে ভয়ে ভক্তি করে। ভালবাসে না কেউ। ভোটে দাঁড়ালে কেন জিতি জানেন? ক্ষমতা আছে বলে? টাকা আছে বলে? ফক্কা। ভোটে জিতি স্রেফ দর্জি ফকিরের ছেলে বলে। ভোট দেয়, জানে হারলে দিদির মনে দুঃখ হবে। তা হলে এই যে আমার ভোটে জেতা সেকি আসলে জিত না হার?
দেখতে দেখতে বেলা গড়ায়। বিদায়লগ্ন এগিয়ে আসে। মনে ভাবি সাধারণ মানুষের মধ্যে দীনদয়ালের এত বড় যে আসন সে আমার এখনও দেখা হয়নি। আমি বৃত্তিহুদার পালবাড়িতে খোদ দীনদয়ালের আসন দেখেছি। আকন্দবেড়েতে দেখলাম আসুনে ফকিরের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সাধারণ মানুষ কেমন করে পেয়েছে দীনদয়ালকে তা আমার আজও দেখা হল না।
গোরুর গাড়ির ছইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ার আগে নূরজাঁহা দূর থেকে সালাম দিলেন নতনেত্রের সৌন্দর্য ছড়িয়ে। কামাল হোসেন বললেন, ‘আবার আসবেন অধীনের গরিবখানায়। আর বাস-রাস্তায় বাউণ্ডুলে খোদাবক্সের হিন্দু হোটেলে একটু ঢুঁ মেরে বলবেন তার ফুফু ক্ষীর আর গোস রুটি নিয়ে বসে আছে। সে হতভাগা যেন বাড়ি আসে।’
হরিমতী দিদি বললেন, ‘দীনদয়াল আবার যেন টানেন তোমায় এদিকে। কিন্তু তখন কি আমি বেঁচে থাকব? দীনদয়ালের পাট এ বাড়িতে আর কদিন? বুড়ো হয়েছি। আমিও মরব আর দীনদয়ালের পাটও উঠে যাবে।’
আমাদের দেশে কিছুকাল একটা নতুন কথার খুব চল হয়েছে। কথাটা হল ‘ফিল্ড ওয়ার্ক রিসার্চ’। এর একটা অদ্ভুত বাংলা হল ‘ক্ষেত্র গবেষণা’। সমাজবিদ্যা নৃতত্ত্ব কিংবা লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন যাঁরা তাঁদের কাছে এই ‘ক্ষেত্র গবেষণা’ একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চার। চলো অযোধ্যা পাহাড়ে, চলো কালীঘাটের পোটোপাড়ায়, চলো ঘোপাড়ায় সতী মা-র মেলায়। এ সব ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের একটা দল নিয়ে থাকেন একজন বা দুজন গম্ভীরদর্শন অধ্যাপক। অনেক সময় স্টাডি-টিমে বিদেশি-বিদেশিনীদেরও দেখা যায়। সবাইয়ের কাছে নোটবই আর ডট পেন থাকে। দলে অন্তত একটা ক্যামেরা আর টেপরেকর্ডার থাকেই।