স্নিগ্ধ লাজুক হেসে দিদি বলেন, ‘তুমি তো বৃত্তিহুদোর পালবাড়ি গেছ? সেখানেই আমার লালন-পালন। আমি ওদের “দোরধরা”। ওকি অমনধারা তাকিয়ে রইলে কেন? “দোরধরা” মানে বোঝ না?”
:না তো।
: শোনো বুঝিয়ে দিই তোমাকে। আমরা জাতে কুমোর। আমার বাবা-মা থাকত হুদো গাঁয়ের পাশে আড়ংসরষেতে। তাদের যখন কিছুতেই সন্তান হল না তখন পালবাড়িতে দীনদয়ালের কাছে সন্তানের জন্যে মান্সা করলে আমার জন্ম হয়। একেই বলে দোরধরা। ছোট থেকেই নাকি আমার ধম্মে মতিগতি। তাই বাবা-মা বিয়ে না দিয়ে পালবাড়িতে রেখে দেয়। তোমাকে যে শরৎ পাঠিয়েছে তার বাবা লালচাঁদ পালের কাছে আমার দীক্ষাশিক্ষা। আমি জন্মবৈরেগী। দীনদয়ালের চরণে পড়ে থাকি।
: এখানে এলে কী করে?
: কেন ফকির বাবার সঙ্গে। তুমি শোননি কামালের বাবা দর্জি ফকিরের ঘটনা? তার বিবি যখন পালাল, বাড়ি গেল পুড়ে তখন তো একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে গিয়েছিল। দীনদয়ালের কৃপায় সব ঠিক হয়। কিন্তু মানুষটা তো শেষপর্যন্ত ফকির হয়ে গেল। সংসার দেখে কে? দীনদয়ালের সেবাপুজো করে কে? কামালকে দেখে কে? ফকিরকে ‘বাবা’ বলে ডেকেছিলাম যে! বাবা তাই যখন বললে, ‘মা, তুই না গেলে আমি বাঁচব না’, তখন আসতে হল।
হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন দিদি। বললেন, ‘কতদিন হয়ে গেল মানুষটা মাটি নিয়েছে। আমাকে মায়ায় বেঁধে রেখে গেল। এই সোনার সংসারের মায়ায় বড় আটকে গেছি ভাই। বুড়ো হয়েছি। চলে গেলে খোদাবক্সকে কে দেখবে? দীনদয়ালের কী হবে সেবাপুজো? তাই ভাবি।’
খাওয়াদাওয়ার আগে ঠিক দুপুরে হরিমতী দিদি আমাকে নিয়ে গেলেন দীনদয়ালের ঘরে। ঠাণ্ডা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একস্টা প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের একপাশে ছোট জলচৌকি। তাতে পাট করা বস্ত্র, তার ওপর কটা ফুল ছেটানো। ত্রিশূল ফকিরিদণ্ড আশাবাড়ি আর হুঁকো। পাল-বাড়ির কোনও গুরুর একজোড়া খড়ম। সামান্য দীন আয়োজন। দীনদয়াল সাহেবধনী তো মূর্তিধারী সাকার নন।
দিদি আসনে বসে নানা ক্রিয়াকলাপ করতে লাগলেন। ধূপের আকর্ষণী গন্ধে, প্রদীপের ঘি-পোড়া গন্ধে চন্দনের গন্ধে ঘরখানি উত্তাল। শান্ত নিরুদ্বেগ শীতল পরিবেশে দীনদয়ালের দিবসী পুজো ভোগরাগ চলল। হঠাৎ দিদি উঠে দাঁড়িয়ে চামর দোলাতে দোলাতে বললেন:
এসো গো ধেয়ানে বোসো গো আসনে
বরণ করি তোমাকে বজ্ৰভরনে।
চামর দুলাই তোমার সুখের কারণে।
জয় দীনবন্ধু দীননাথ।
মেঝেতে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন:
জয় দীনদয়াল অটলবিহারী করোয়াধারী।
দীনদয়াল সাহেবধনীর নামে একবার হরি হরি বলো
হরিবোল
আবার খানিকক্ষণ ধ্যানস্থ থেকে বললেন;
ক্লিং ক্লিং দীনদয়াল সাহেবধনী সহায়।
সাহেবধনী আল্লাধনী সহায়।
গুরু সত্য। চারিযুগ সত্য। চন্দ্রসূর্য সত্য।
খাকি সত্য। বাক সত্য। কাম সত্য। করণ সত্য।
গোঁসাই দরদী সাঁই
তোমা বই এ জগতে আমার কেহ নাই।
আমি ভাবতে লাগলাম কী বিচিত্র এই লৌকিক ধর্মের জগৎ। হরিবোল ধ্বনির সঙ্গে আল্লার নাম মিশে যাচ্ছে। কী অদম্য বিশ্বাসের জোরে গুরু সত্য আর কাম সত্য একই উচ্চারিত হচ্ছে। চারিযুগ চন্দ্রসূর্য সবই সত্য? সেই সঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণবের বীজমন্ত্র ক্লিং ক্লিং ধ্বনিও একাঙ্গ? কেমন করে হয়? যেমন করে এ ঘরের নির্জন প্রকোষ্ঠে মিলে যায় ধূপগন্ধের সঙ্গে চন্দনসুরভি আবার তার সঙ্গে প্রদীপের ঘিয়ের পোড়া গন্ধ? দীনদয়ালের এই শান্ত শীতল আধো-অন্ধকার নিরুদ্বেগ ঘরখানির সঙ্গে বাইরের দাবদাহ-ঘেরা গ্রীষ্ম প্রকৃতির কোনও মিল নেই অথচ। মিল নেই মানুষে মানুষেও। এ ঘরের বাইরে পা দিলেই আমি হিন্দু, কামাল হোসেন মুসলমান। সেখানে মকবুলের সঙ্গে আমার মেয়ের কোনওদিন মিলন হতে নেই।
যেন আমার স্বপ্নাচ্ছন্নতা ছিন্ন করতেই একসময় হঠাৎ শেষ হয়ে গেল দীনদয়ালের দিবসী পুজো। বাইরের-বারান্দায় এসে বসলাম ধ্বস্ত দুপুরে। চার দিক গরমের ভাপে দুঃসহ। হরিমতী দিদি বোধহয় অন্তর্যামীর মতো বুঝলেন আমার মনের তাপ আর অন্তর্বেদনা। খুব শান্তভাবে গায়ে হাত বুলিয়ে আমাকে বললেন, ‘তুমি বোসো এখানে দু দণ্ড। আমি তোমাকে একখানা গান শোনাই। শান্তি পাবে মনে।’
আশ্চর্য মধ্যসপ্তকে শুরু হল কণ্ঠবাদন:
রাম কি রহিম করিম কালুল্লা কালা
হরি হরি এক আত্মা জীবনদত্তা
এক চাঁদে জগৎ উজ্জ্বল।
আছে যার মনে যা সেই ভাবুকতা
হিন্দু কি যবনের বালা।
লক্ষ্মী আর দুর্গাকালী ফতেমা তারেই বলি
যার পুত্র হোসেন আলী মদিনায় করে খেলা
আর কার্তিক গণেশ কোলে করে
বসে আছেন মা কমলা।
হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিল একটা অদ্ভুত অনুভূতির ঝড়ে। কে লিখেছিলেন এমন গান? সে কি আজকের দিনটার কথা ভেবে? মা কমলার কোলে কার্তিক গণেশের মতোই কি হরিমতী দিদির কোলে বসে আছি আমি আর কামাল হোসেন? একই স্নেহে ভালবাসায় উত্তাল হয়ে? এ কোন মানবিক মনীষী এক শতাব্দীর আগের গ্রামে গেঁথে গিয়েছিল এমন গান? ততক্ষণে গানের শেষ অংশে পৌঁচেছেন দিদি গাঢ় উচ্চারণে:
কেউ বলে কৃষ্ণরাধা কেউ বলে আল্লাখোদা
থাকে না তেষ্টা ক্ষুধা
ঘুচে যায় জঠরজ্বালা।
মনে ভেবে দ্যাখো একই সকলে
পারো রে এক নামের মালা।
এক লয়ে ভাগলটি এক পানি একই মাটি
এক হাওয়া জেনো খাঁটি
একের কবল এই কলা ॥
আমি অপলক চেয়ে থাকি হরিমতী দিদির দিকে। তাঁর চোখে জল। সে কি আনন্দের না ভক্তির?