কামাল হোসেনের কথা তো নয় যেন বুলেট। ঝাঁঝাঁ করে ওঠে মাথা। বিদ্ধ হয় একেবারে মর্মস্থলে। কী জবাব দেব? সত্যিই তো সমাজের ফ্রেম আমাদের অনড়, সংস্কার অতলস্পর্শী। শুধু গ্রামে কেন, শহরেও নয় কি? আমাদের কোনও ভাইপোই যদি হৃদয়ের উদারতায় ভালবেসে কোনও রোকেয়া খাতুনকে বিয়ে করতে চায়, আমরা কি প্রথমেই বাধা দেব না? যদি বা তার অতি স্বাধীনচিত্ততার বা ভাল চাকরির ব্যক্তিত্বের সুবাদে সে বিয়ে আমরা মেনে নিই তবুও কি কার্ডে ছাপাতে পারব রোকেয়ার নাম? তার বাবার সত্যিকারের পরিচয়? সত্যি এমন বিপদে কখনও পড়িনি। দুর্গতি তখনও বাকি ছিল। আমার চরম দুর্বল মুহূর্তে কামাল দিলেন আরেক মুষ্ট্যাঘাত। বললেন, ‘আপনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তো অধ্যাপক ছিলেন। আপনি তো আবার সাহেবধনীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তা আপনার একটা মেয়ে আছে শুনেছি। তার বিয়ে দিতে পারবেন কোনও মুসলমান ছেলের সঙ্গে? আচ্ছা আপনাকেও দিতে হবে না, সে যদি নিজেই বিয়ে করতে চায়? আপনার অধ্যাপিকা স্ত্রী সহজে রাজি হবেন? তিনি কি এই বলে মেয়েকে গাল দেবেন না যে ‘ছি ছি, কোন বাবার মেয়ে হয়ে তুই কী করলি? সমাজে কলেজে ছাত্রীদের কাছে আর আমি মুখ দেখাতে পারব?’ কী? বলবেন না এই কথা? বুকে হাত দিয়ে বলুন? কিন্তু মুসলমান সমাজ আমার ছেলে-মেয়েকে নেবে। আমি নাস্তিক বা উদারপন্থী জানলেও নেবে। সেই জন্য আমাকে আলেম সাজতে হয়। সবাইকে বলতে হয় নামাজ পড়ো। এর কারণ বোঝেন?’
: কী এর কারণ?
: এর কারণ, ভাল হোক মন্দ হোক আমাদের দেশের শরিয়তভিত্তিক মুসলমান সমাজ ধর্মের বাইরের আচরণকে খুব বেশি দাম দেয়। সমাজ শুধু দেখে, লোকটা নামাজ পড়ে কি না, মসজিদে যায় কি না, কলমা মানে কি না। যদি মানে, ভণ্ডামি করেও মানে, তবু তার সাত খুন মাপ। এই জন্যে আমি আচরণে মুসলমান। আমি বাবার মতো ফকিরি করলে কি সমাজে এত গণমান্য হতাম?
একেবারে ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের মতো একজন এই সময় বেরিয়ে এসে অসহায় আমাকে বাঁচালেন। হরিমতী দিদি। গেরুয়া আলখাল্লা। গলায় তসবী মালা। টকটকে গায়ের রং। সৌম্য চেহারা। দারুণ একটা হাসি মুখে নিয়ে বাড়ি থেকে বার হয়ে কামালকে ধমকালেন, ‘হ্যাঁরে খ্যাপা, শরিয়তে কোথায় লেখা আছে যে বাড়িতে মেহমান এলে তাকে খেতে বসতে না দিয়ে শুধু বকাঝকা করতে হয়? জ্ঞানহারার মতো চ্যাঁচাচ্ছিস? ওকে ঘরে আনবি নে?’
‘বেশক বেশক। চলুন চলুন। তসরিফ রাখিয়ে’, কামাল মুখ টিপে হাসলেন।
ঘরের ভেতরে বসিয়ে হরিমতী দিদি আমাকে পাখার বাতাস করতে লাগলেন ‘মুসলমান হলেই কি হয়? মেহমানের কদরদানী জানিস? সে জানত বাবা।’
কামাল আমার দিকে চোখ টিপে দিদিকে বলল, ‘এখন তোমার হিন্দু ভাইয়ের খিদ্মদ্গার করো। তার বহুত পরেশানি হয়েছে। মুসলমান ভাইটি চুলোয় যাক। তা হিন্দু ভাইয়ের জন্য সারা সকাল ধরে যে ক্ষীর রাবড়ি লুচি হল তা কি এই দুশমন ভাই পেতে পারে না? খাওয়া-দাওয়ায় কিন্তু হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই।’
‘বেরো এখান থেকে’ পাখার বাঁটের এক ঘা খেলেন কামাল।
‘তুই কি না খেয়ে ছাড়বি নাকি? লজ্জা করে না? গোপাল-মীরা বাড়ি নেই, খোদাবক্স খায়নি। তোর এত নোলা আসে কোত্থেকে?’
‘পালাই, ব্যাপার খারাপ’, বলে কামাল সত্যিই চললেন। যাবার ঠিক আগে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘একটু চারদিক ঘুরে আসি। পেশেন্টটাও দেখে আসি। জলখাবার খান। হরিমতী দিদির সঙ্গে কথাবার্তা বলুন। তাঁর সঙ্গেই তো আপনার আসল কারবার। দুপুরে খেয়ে উঠে আবার তর্ক হবে কেমন? আর হ্যাঁ, ভাল কথা, দিদির গান একটা শুনবেন তোয়াজ করে। দিদির আমার স্নেহ নেই, মায়া নেই, দরদ দুঃখ কিছু নেই। চেহারাও তো দেখছেন পেঁচির মতো, তাই আব্বাজান বিয়ে দিয়ে যেতে পারেনি। আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। তবে দিদির আমার গানের গলাটা বড় ভাল। ওই গানটা শোনায় বলে দুবেলা দু মুঠো খেতে পায়। নইলে কবে তেড়িয়ে দিতাম।’
‘ভাগ ভাগ’, হরিমতী দিদি হাসিমুখে এগিয়ে ভাইকে মারলেন এক ঘুঁষি। বললেন, ‘তোর পয়সা লবডঙ্কা। সব আমার বাবার। এই, তাড়াতাড়ি খেতে আসবি সোনা।’
এমন একটা মধুর পরিবেশে মনটা স্বভাবতই নরম হয়ে যায়। হরিমতী দিদির তৈরি ক্ষীর রাবড়ি লুচির স্নিগ্ধ স্বাদ সেই নরম মনে এমন একটা সুবাসিত উদ্যানের ব্যাপকতা আনে যে আমার সব দিকে তালগোল পাকিয়ে যায়। হরিমতী দিদি আমার মনের সেই উথাল-পাথাল বুঝে কাছে আসেন। স্নিগ্ধস্বরে বললেন, ‘সবই মানুষের লীলা। দীনদয়াল আমাকে কতই দেখালেন। নইলে আমার এই বাড়িতে ঠাঁই হয়? এ বাড়ি তো স্বর্গ। শুধু তো আমার পাগলা ভাইটিকে দেখলে। রসুই-ঘরে সুন্দরী বউবিটিকে এখনও তো দ্যাখোনি। সে তোমার জন্যে চালের রুটি, মুর্গির মাংস বানাচ্ছে। মীরা গোপালকে দেখলে না, একেবারে সোনার ছেলেমেয়ে। আর সবাইকে টেক্কা দিয়ে সেই শয়তান নচ্ছার খোদাবক্সটা। কে জানে ছোঁড়া আজ বাড়ি আসবে কিনা।’
আমি ভাবলাম দীনদয়াল আমাকেও বড় রকম দেখালেন না। মাধুর্যের এমন বর্ণময় ছবির চারপাশে মানবিকতার এমন পোক্ত ফ্রেম তো আগে কখনও দেখিনি। অনেকটা যেন আপ্লুত হয়েই বললাম, ‘দিদি, তোমার কথা শুনব আমি। তুমি কেমন করে এ বাড়ি এলে? কোথাকার লোক তুমি?’