উল্লসিত কণ্ঠে জবাব আসে, ‘অতি অবশ্য। আমি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। তাই একটু আধটু পার্টি করতে হয় বইকী। এখনকার দিনে পার্টি না করলে জমি জিরেত দোকান মাস্টারি পঞ্চায়েত সব ঠেকানো যায়? শহরের বিখ্যাত কমরেডরা মাঝে মাঝে এই গরিবের দলিজে পা রাখেন।’
: আপনার তা হলে এ গাঁয়ে কোনওই অসুবিধে নেই?
আকাশের দিকে হাত তুলে কামাল হোসেন বললেন, ‘সবই খোদাতাল্লার ইচ্ছা। আমি গ্রামের একজন আলেম মানুষ হবার জন্যে মসজিদ বানিয়ে দিয়েছি। ইমানদার মুসলমান সমাজের নেকনজর পাবার আশায় ছেলেকে ভর্তি করেছি মাদ্রাসায় আরবি পড়তে। সাধারণ গরিব-গুরবো মানুষকে বশ করেছি হেকিমি করে। গাঁয়ের কিনরা বেশির ভাগ আমার জমিতে অন্নদাস। বাউল বোরেগীরা মান্য করে দর্জি ফকিরের ছেলে বলে। হিন্দুরা আমাকে প্রোগেসিভ ভাবে কেননা মেয়েকে শহরে পাঠিয়েছি উচ্চশিক্ষায়। এস, ডি, ও, বি. ডি. ও, বাবুরা সমীহ করেন রাজনীতি করি বলে।’
‘কিন্তু যুবসমাজ? বেকাররা?’, আমার জিজ্ঞাসা।
: তাদের জন্য যে আলকাপের দল বানিয়েছি। কটাকে বেকারভাতা জুটিয়ে দিয়েছি। যাত্রাদল আনি শীতকালে।
: কিন্তু আপনি শরিয়ত মানেন?
: সামানা-সামনি সবই মানি। সবাইকে বলি ‘মসজিদে যাও’ নামাজ পড়ো’। কিন্তু আসলে কিছুই মানি না। কেন? মূলে যে দর্জি ফকিরের পয়দা করা মাল আমি—সেটা ভুলি কী করে? ঘরে আছেন আমার হরিমতী দিদি আর মহামান্য দীনদয়াল দীনবন্ধু গোপ্তবাবাজি। আসলে হিন্দু-মুসলমান বলে সত্যিই কি কিছু আছে? আপনি মানেন? একটা মজার ঘটনা শুনবেন?
: বলুন। আপনার সব কথাই বেশ মজার।
বেশ খানিকটা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে কামাল বললেন: ‘আমার এক ভাগনে আছে অপোগণ্ড। চাচাতো দিদি অল্প বয়সে মারা গেলে আমার ভাগনেটাকে আমিই এনে মানুষ করেছি। ভাল লেখাপড়া করল না। বাউন্ডুলে টাইপ। হরিমতী দিদির কাছে মানুষ। কোনও কাজে লেগে থাকতে পারে না। তবে সৎ। আমার বিবি ওকে খুব পছন্দ করে। তাকে কীসে কোন কাজে যে লাগাই ভেবে পাইনে। ছেলেটা কিন্তু বুদ্ধি ধরে। একদিন এসে বলে, ‘চাচা কিছু টাকা দেবে?’ কী করবি জিজ্ঞেস করতে বলে, ‘হোটেল খুলব।’ আপনি যেখানে বাস থেকে নামলেন ওখানে আজকাল মালদা বহরমপুর আর উত্তরবঙ্গের বাস থামে। ছোকরা খুলে দিলে এক হোটেল।’
: সে কী? মুসলমানের হোটেলে সাধারণ পাবলিক ভাত-ডাল খাচ্ছে?
‘আরে ছোঁড়ার প্যাঁচটা শুনুন। তার খোলে খোলে বুদ্ধি।’ ভাগনের বুদ্ধির তারিকে মামা হেসে বলেন, ‘আমাদের গাঁয়ে রাম চক্কোত্তি বলে একজন আছে। গৌরবর্ণ সুন্দর চেহারা। কিন্তু রাঙামুলো। গোমুখ্যু। তবে ভোজে-কাজে রাঁধে ভাল। আমার ভাগনে খোদাবক্স তাকে বললে, ‘রামকাকা চাকরি করবে?’ সে রাজি হয়ে গেল। ব্যস, ছোঁড়া বাস-রাস্তায় হোটেল খুলল। খালি গায়ে মোটা পৈতে পরে রাম চক্কোত্তি রাঁধে-বাড়ে খদ্দেরদের পরিবেশন করে।’
: আর খোদাবক্স? |
: পাকা শয়তান। সে ভালমানুষের মতো মুখ করে কাউন্টারে বসে টাকা পয়সা আদায় করে। মাছ মাংস সবজি কেনে। ছোকরা এত বড় বাঁদর যে হোটেলের নাম দিয়েছে বড় অদ্ভুত। ভাবতে পারেন? নাম দিয়েছে—‘খোদাবক্সের হিন্দু হোটেল’। খাসা চলছে। তাই আপনাকে বলছিলাম হিন্দু-মুসলমান বলে কিছু নেই। সব সাজানো।
এমন একটা দারুণ চোখ-কান-খোলা চালিয়াত মানুষ এতটা উদার হয় কী করে? আমার মনে ধন্দ জাগে। এ তো পাক্কা রিয়ালিস্ট, আচারে কম্যুনাল অথচ মনের মধ্যে এতটা স্বচ্ছ হয় কোন মন্ত্রে? এই কি তবে দীনদয়ালের ঘরের সত্যিকারের শিক্ষা? একটু যাচাই করতে লোভ জাগে। জিজ্ঞেস করে বসি, ‘মাস্টারমশাই থুড়ি হেকিমসাহেব, আপনার ছেলেমেয়ের নাম কী রেখেছেন?’
‘খুব ভাল কথা তুলেছেন। হরিমতী দিদি ওদের ডাকে গোপাল আর মীরা বলে। ওদের ইস্কুল কলেজের পোশাকি নাম মকবুল হোসেন আর রোকেয়া সুলতানা’, কামাল বলেন।
আমি ককিয়ে উঠি, ‘সে কী? মুসলমানি নাম কেন?’
: আরে রসুন রসুন। মাথা ঠাণ্ডা করুন আগে। খুব তো হিন্দুয়ানির বড়াই করেন, হিন্দুজাতি খুব উদার নাকি, তো একটা ধন্দের জবাব দেবেন কি মেহমান? এই যে আমি মানুষটা। এতক্ষণে আপনি তো অন্তত বুঝেছেন যে আমি ধর্ম মানি নে? ঘরে আমার হরিমতী দিদি, ভেতর ঘরে দর্জি ফকিরের দীনদয়াল, তবু আমি কেন মুসলমানি কেতা মেনে চলি? কারণ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে হবে যে! সমাজ বলে একটা জিনিস আছে মানেন?
: সমাজ মানি বইকী? আমাদের শহুরে সমাজের আঁটাআঁটি কমে আসছে। তবে গ্রামসমাজে নানা বন্ধন বা নিয়ম-কানুন আছে মানি।
কামাল প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আপনি কেমন যেন দায়সারা গোছের সাজানো কথা বলে যাচ্ছেন মহাশয়। শুনুন স্পষ্ট করে বলি। আমাদের গ্রাম-ঘরে লাভ ম্যারেজ ফ্যারেজ খুব একটা হয় না। এখানে ছেলেমেয়ের বাবা মা-ই বিয়ের পাকা বন্দোবস্ত করে। এবারে বলুন মকবুলকে কোন হিন্দুবাড়ি বিয়ে দেওয়া যাবে? সবাই তো জানে আমার ঘরে দীনদয়ালের আসন, হরিমতী দিদির বাস। সবাই এটা ভাল করেই জানে যে আমি পুরাণ-কুরান কোনওটাই অন্তর থেকে মানিনি। তবু কি আপনার ভাইপোর সঙ্গে আমার মীরার বিয়ে দেবেন? দেবেন না। অথচ মীরা আমার রূপসী আর গুণের মেয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ে। পণের টাকাও আমি অগাধ দিতে পারি। তবু হিন্দুরা তাকে নেবে না। তা হলে উদারতা উদারতা বলে চেঁচান কেন?’