এ যে দেখি গাঁয়ের মধ্যে খাঁটি আরব্যোপন্যাস। খাড়া হয়ে বসি কৌতূহলে। কী হয় কী হয়। গাড়োয়ান একটু দম নিয়ে বলে: ‘মোটমাট তিনশো আকবরি মোহর ছিল। মনের খুশে জমিদারবাবু দর্জিকে দিয়ে দিলেন একশো মোহর। কপাল খুলে গেল মানুষটার। মস্ত বড় দালানকোঠা দলিজ উঠল। খুব রমরমা। তেমনই বোলবোলাও। টাকার গরমে মানুষটার মাথাও গেল ঘুরে। মোহরের তাপ আর দাপ কি সোজা? মাথার গরমে কতদিনের লক্ষ্মীমন্ত বউকে দিলেন তালাক। সে হল আত্মঘাতী। কামাল তখন বালক। আসলে অন্য দিকে মন তখন মানুষটার। ফুরফুরে সুন্দরী সালেহা বিবিকে ঘরে আনলেন বেলডাঙা থেকে। এদিকে হঠাৎ এক রাতে সালেহা সুন্দরী বাকি মোহর আর চাচাতো ভাইকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। আর হবি তো হ, দিন সাতেকের মধ্যে অতবড় দালান-কোঠা হঠাৎ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সবাই বললে তালাক-খাওয়া লক্ষ্মীমন্ত বউয়ের অভিশাপে এমন হল। মানুষটা দিনকতক পাগল-পাগল হয়ে ঘুরে কার বুদ্ধিতে কে জানে পড়লেন হুদোর পাল বাড়িতে দীনদয়ালের চরণে। ব্যস মাথা ঠাণ্ডা। দীনদয়ালের কৃপায় জীবনে শান্তি এল আবার। ফকিরি নিলেন। বাড়িতে দীনদয়ালের আসন হল। সদাই গান করতেন। সেই থেকে নাম রটে গেল দর্জি ফকির।’
: তুমি দেখেছ দর্জি ফকিরকে?.
: হ্যাঁ, আবছা মনে আছে। তখন আমার বালক বয়স। ফকিরের ছিল এই সাদা দাড়ি। গান করতেন সদা সর্বদা, সেটা মনে পড়ে।
গল্পে গল্পে কখন আকন্দবেড়়ে এসে গেছে। হইহই করে অভ্যর্থনা করলেন কামাল হোসেন। বছর পঞ্চাশ বয়সের সমর্থ চেহারার মানুষ। লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। ‘আসুন আসুন, গরিবের কুঁড়ে ঘরে’ বলে হাতে গুঁজে দিলেন ফিল্টার কিংস। কুঁড়েঘর অবশ্য নয়, পাকাবাড়ি। বাড়ির পেছনবাগে ভটভট করে গমকল চলছে। ফিল্টার কিং-এ একটা মোক্ষম টান মেরে ছাড়লেন একরাশ আত্মতৃপ্তির ধোঁয়া। সেইসঙ্গে সংলাপ: ‘এ দিগরে গম পেষাই কল এই একটাই। স্টোর মালিকানা এই অধমের।’
মানুষটির দিকে ভাল করে চেয়ে দেখি এবারে। পেটা চেহারায় আসনাই রোশনাই প্রচুর। চোখে সূক্ষ্ম সুর্মার টান, মানানসই বাবরি। চারপাশে অযাচিত মোসায়েবের দল। হাবেভাবে বোঝা গেল কামাল সাহেব বেশ সম্পন্ন আর প্রতিষ্ঠাবান নেতা ব্যক্তি। এ গ্রামে সম্ভবত তাঁর কথাই শেষ কথা। এঁর বাবা ছিলেন সর্বত্যাগী ফকির, ভাবা যায়? কথা বলবার জন্যে, নিজেকে জাহির করতে মানুষটি বড়ই অস্থির। এ সব লোককে আমি ইচ্ছে করে খুব উসকে দিই। গলগল করে কথা বেরিয়ে আসে। তাঁর কথার ধরতাই মিলিয়ে এবারে বুদ্ধি করে বলি: ‘মনে হচ্ছে শুধু গমকল নয়, কামাল সাহেবের যেন অনেক কিছুই অদ্বিতীয় এ গ্রামে?’
: বেশক বেশক। গুণী লোক গুণীর আদর বোঝেন। গাঁয়ের একমাত্র রাজদূত বাইক অধমের বাড়িতে বাঁধা। দুখানা দোনলা বন্দুক। একমাত্র এই অধমের মেয়ে শহরের কলেজে পড়ে। গ্রামের সবেধন নীলমণি কোয়ক ডাক্তার আমি। ছেলে দ্বীনি আরবি পড়ে কলকাতা মাদ্রাসায়।।
হয়তো অদ্বিতীয়ের তালিকা আরও লম্বা। কিন্তু মাঝপথে বাধা পড়ল। একজন গেয়ো গরিব এসে বলল, ‘হেকিম ছাহেব, মেয়েটার দাস্ত তো হয়েই চলেছে, আমরক্ত। পেট মুচড়ে তেমনি বেদনা। যন্তরনায় মেয়ে আমার কোঁকাচ্ছে গো।’
‘হুম’ গম্ভীর আওয়াজ করলেন কোয়াক ডাক্তার, আপাতত হাকিম সাহেব। মুখটা চিন্তিত করে তুলে আমাকে হঠাৎ বললেন, ‘বুঝলেন তো কেসখানা? একেবারে কেরোসিন। ছটা এন্ট্রোস্টেপে কাজ হল না। তবে কি ইঞ্জেকশন দেব নাকি?’ মুখ ঘুরিয়ে লোকটিকে বললেন, ‘তুমি ঘরে যাও, আমি ভেবে দেখি।’ দুজনে এগোলাম। বাড়ির ঠিক পাশে, রাস্তার ওপরে রয়েছে একখানা দোকান। দোকানের এক অংশে বই খাতা পেন্সিল কলম কালি বিক্রি হচ্ছে, আরেকদিকে জমির সার, কীটনাশক, বীজ আর প্রে মেশিন। আমার এতদিনের গ্রাম পরিক্রমায় এমন সারবান দোকান কখনও দেখিনি। বিস্মিত কণ্ঠে বলতেই হয়: ‘এ দোকানও কি আপনার?’
‘একেবারে যথার্থ অনুমান করেছেন। এ দোকানটা আমারই। বেকার ভাইপোকে বসিয়ে দিয়েছি। দোকানের আইডিয়াটা কেমন বলুন তো? জীবনের সার শিক্ষা আর জমির সার সুফলা ইউরিয়া আমি একসঙ্গে বেচি। মানব জমিন আর খোদার জমিন দুয়েরই চাষ চলবে।’ কামাল হোসেন নিজের রসিকতায় নিজেই হাসেন হো হো করে। মোসায়েবরাও গোঁজামিল হাসির কোরাস তোলে।
আমি বেশ খানিকটা মজা পেয়ে বলি, ‘কামাল সাহেব, এইটুকু সময়ে আপনার এত রকম রূপ দেখলাম যে বুঝে উঠতে পারছি না আপনাকে কী বলে ডাকব। ডাক্তারবাবু, কামালভাই না মিস্টার হোসেন?
‘আরে আরে, দাঁড়ান দাঁড়ান। এখনও আপনি আমার কিছুই দেখেননি। তবে সমিস্যেটা ভাল ধরেছেন। এ গাঁয়ে বেশির ভাগ লোকজন আমাকে জানে দর্জি ফকিরের ছেলে কামাল বলে। আলেম সমাজে আমি ছায়েব। পেশেন্টরা বলে হাকিম সাহেব। কেউ কেউ বলে মাস্টার মশাই…
: মাস্টারিও করেন নাকি?
: আমি তিন রকমের মাস্টার। এক, প্রাইমারি ইস্কুলের হেড মাস্টার, দুই, আলকাপ গানের দলের মাস্টার…আর তিন নম্বর কী বলুন তো?
: এ ছাড়া তিন নম্বর মাস্টার আর কী হতে পারে?
: হুঁ হুঁ, এই দেখুন বাড়ির গায়ে বাঁধা লাল ডাকবাক্স। আমি পোস্টমাস্টারও যে। খাম পোস্টকার্ড বেচি।
বিস্মিত আমার আর একটা অনুমানাত্মক প্রশ্নও লক্ষ্যভেদ করে, ‘হাজী সাহেব কি রাজনীতিও করেন নাকি?’