শরৎ পাল বলেছিলেন: ‘না। আমাদের এই পাল বাড়ি থেকে দীনদয়ালের ঘরের সত্যনাম যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে যারা ভাল ভক্ত, মধ্যম রকম শিক্ষিত, ভাল বলতে-কইতে পারে তাদের আমরা বিশেষ অনুমতি দিই তাদের নিজ গ্রামে নিজ-বাস্তুতে দীনদয়ালের ‘আসন’ প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের বলা হয় ‘আসুনে ফকির’। তারা দীক্ষাদানের অধিকারী। সায়ংসন্ধ্যা দীনদয়ালের পুজো উপাসনা করে তারা। তারাই আমাদের শিষ্য বাড়ায়। অগ্রদ্বীপের যে মেলা বসে চৈত্র একাদশীতে, সেখানে আসুনে ফকিররা তাদের শিষ্য-শিষ্যা নিয়ে আসে। মচ্ছবের চাল-ডাল দেয়। আমাদের ঘরে খাজনা দেয়। আর আমরা তাদের দিই একটা করে মাদুর একটা করে হুঁকো।’
: ভারী অদ্ভুত নিয়ম তো? লোকধর্মের অনেক দেখা আমার অভিজ্ঞতাও রীতিমতো বিস্ময় মানে। জিজ্ঞেস করি: ‘তার মানে আসুনে ফকিররা আপনার কাছে দায়বদ্ধ আর সাধারণ শিষ্যরা আসুনে ফকিরদের কাছে দায়ী, এই তো? তা আসুনে ফকিরদের নাম-ঠিকানার একটা তালিকা আপনার কাছে আছে তো?’
: নিশ্চয়ই। আপনি অগ্রদ্বীপের মেলায় দেখেননি লালখেরোর খাতা নিয়ে গোমস্তা আসুনে ফকিরদের জরিমানা নেয়?
: জরিমানা?
: হ্যাঁ, আমাদের মতে খাজনাকে বলে জরিমানা। আমরা তাদের ঐহিক কর্তা যে।
: বাঃ চমৎকার সিসটেম। তা আপনাদের অনেক কিছু তো দেখা হল, এখন আমার দুটো আগ্রহ আছে। এক, একজন আসুনে ফকিরকে দেখা, আর দুই, একজন দীনদয়ালের খুব সাধারণ ভক্তকে কাছ থেকে দেখা। এই সাধারণ ভক্তকে আমি খুঁজে নেব যে-কোনও গাঁয়ে। কিন্তু একজন আসুনে ফকিরকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে গেলে তো আপনার মতামত দরকার। ঠিক কার কাছে গেলে ক্রিয়াকলাপ দেখা যাবে, কে সব ঠিকমতো বোঝাতে পারবে, সেটা আপনিই ভাল বুঝবেন। তা ছাড়া যদি একটা চিঠি লিখে দেন তো খুব সুবিধে হয়।
শরৎ পাল খুব চিন্তা করে জিজ্ঞেস করলেন, কীরকম আসুনে ফকির দেখবেন? হিন্দু না মুসলমান?’
আমি বললাম, ‘আমার ও সব তফাত নেই।’
শরৎ পাল একটু হেসে বললেন, ‘পুরুষ না নারী?’
এবারে চমকাতে হল। পুরুষ বা নারী দুজনেই দীক্ষাগুরু হতে পারেন নাকি সাহেবধনী মতে?
শরৎ পাল বললেন: ‘আমাদের ঘরে এককালে খুব নামকরা মহিলা ছিলেন জগতীমাতা, দিনুরতন দাসী, লক্ষ্মীটগর। তাঁদের অনেক শিষ্য ছিল। এখনও অনেক আছেন। ঠিক আছে, আপনাকে একটা খুব মজার জায়গায় পাঠাচ্ছি। চলে যান আকন্দবেড়়ে। চেনেন তো? সেখানে দর্জি ফকিরের বাড়ি যাবেন। তার ছেলের নাম কামাল হোসেন। খুব নামকরা লোক। সবাই চেনে। দর্জি ফকির ছিলেন আমাদের ঘরের খুব পুরনো আসুনে ফকির। এখনও আসন আছে। তবে কামাল ফকিরি নেয়নি। ভোগরাগ, নিত্য পূজা, দিবসী, মন্ত্রদীক্ষা সব করে হরিমতী। সে কিন্তু হিন্দু। কামাল তাকে দিদি বলে। দর্জি ফকিরকে হরিমতী ‘বাবা’ বলে ডেকেছিল। সেই থেকে ওই বাড়িতে থাকে। বিয়ে-থাওয়া করেনি। দীনদয়ালের খুব ভক্তিমতী সাধিকা।’
বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়ের ধাক্কা। বলেই ফেলি: ‘মুসলমান বাড়িতে হিন্দু মেয়ে বাস করে?’
শরৎ পাল আহত ভঙ্গিতে বলেন: ‘সব বুঝেও মাঝে মাঝে আপনার ঠিকে ভুল হয়ে যায় বড্ড। আমাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান বিচার নেই। ওটা আপনাদের হিসাব।’
লজ্জিত হই। সত্যিই ভুল হয়ে যায় বারে বারে। সংস্কার বড় সাংঘাতিক। শরৎ পালের কাছে মার্জনা চেয়ে তাঁর কাছ থেকে একটা চিঠি লিখে নিয়ে বিদায় নিই সেদিনের মতো।
যাবার দিনক্ষণ মোটামুটি জানিয়ে আকন্দবেড়ের ঠিকানায় একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলাম কামাল হোসেনকে। তার ফল পাওয়া গেল হাতে নাতে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল এক দিব্যি ছই-দেওয়া গোরুরগাড়ি। আকন্দবেড়়ের হাঁটা পথ ক্রোশ দুই তো বটেই। সেটা মালুম হল গাড়িতে যেতে যেতে। দারুণ গ্রীষ্মে গাড়োয়ান গাড়ি চালাতে কুল কুল করে ঘামছে। লোকটা মাঝে মাঝেই সম্রম নিয়ে আড়চোখে দেখছে আমাকে। ভাবছে বোধ হয় কামাল হোসেন হেন আলেম ব্যক্তি যাকে আনতে গো-গাড়ি পাঠায় না জানি তিনি কতবড় লায়েক ব্যক্তি! লোকটার জড়তা কাটাতে নানা খুচরো প্রশ্ন করি সেও হুঁ হাঁ দিয়ে পাশ কাটায় কিংবা অকারণে গোরুর সঙ্গে কথা বলে অবান্তর অব্যয় মিশিয়ে। এ তো ভারী মুশকিল। কাঁহাতক চুপ করে থাকা যায়। তাই একটা বিশদ কৌতূহল জ্ঞাপন করে বসি: ‘হ্যাঁ গো কত্তা, তোমাদের এই কামাল সায়েবের আব্বাজানকে তুমি দেখেছ? বাঃ তা আমার মনে একটা কথা খুব জেগেছে।’
গাড়োয়ান বলে, ‘কহেন’।
: আচ্ছা, মানুষটির নাম অমন অদ্ভুত কেন? দর্জি ফকির আবার কী নাম? মানুষটা দর্জিগিরিও করতেন আবার ফকিরিও করতেন নাকি?
: আজ্ঞে না। প্রথমে ছিলেন শুধুই দর্জি। খুব গরিব মানুষ। রুকুনপুরের নাম শুনেছেন বাবু? তা সেখানকার জমিদার একবার দর্জিকে ডেকে পাঠান তাঁর এক সাবেকি গদি সারাবার জন্যে। এ সব আমাদের শোনা কথা আজ্ঞে। সেই গদি একটা ঘোড়ার এক্কায় চড়িয়ে উনি তো এলেন আকন্দবেড়ের ভিটেয়। পরদিন গদি খুলে তো অবাক। তার মধ্যে সেলাইয়ের ফোকরের চারভিতে গদির চারধারে শুধু মোহর শুধু মোহর!
: সেকী! তারপর?
: উনি তো মাথায় করাঘাত করেন আর কাঁদেন, ‘আই আল্লা এ কী পরীক্ষা আমার।’ কাউকে বলতেও পারেন না। যদি ডাকাতি হয়? সে রাত কোনওরকমে কাটিয়ে গদি নিয়ে ফিরলেন। জমিদারবাবু সব শুনে তো থ। তিনি মোহরের কথা কিছু জানতেন না। তেনার বাপ-পিতামোর কাণ্ড আর কী!