‘খুন?’ আমি সচকিত হয়ে বললাম।
‘আরে না না, খুন নয়।’ জনার্দন বললে তবে রে, চললাম আমি আর এস পি অফিসে। আজ থেকে আর সি পি এম করব না। সত্যিই জনার্দন সেই থেকে খুব আর এস পি করে। সেই কোঁদলে মূর্তিপুরে ভোট ভাগ হয়ে গেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ও অঞ্চলে ফ্রন্ট হেরেছে। এই তো গাঁয়ের রাজনীতি।
শহরে থাকি। খবরের কাগজ পড়ে গ্রাম্য রাজনীতির খবর পাই। তাতে তো কোনওদিন এ সব খবর বেরোয় না। তাই অবাক লাগে খুব। তার চেয়েও সন্ত্রম আসে স্থিতধী সুফল সরকারের বিশ্লেষণে, ঘটনা সাজানোর বিন্যাসে। কিন্তু মানুষটার নিজের কথা জানা খুব শক্ত। প্রায় কিছুই বলেন না। খোঁচাতেই হয় কৌশলে। জিজ্ঞেস করি: ‘সারাদিন তো জমির কাজে কাটে আপনার। সন্ধের পর কী করেন? হরিনাম?’
খুব অবজ্ঞার সুরে উত্তর এল: ‘হরিনাম করে পাপী-তাপী। আমার ও সব বালাই নেই। পাপ তো কিছু করিনি। বিশ্বাসও নেই পাপপুণ্যে, ভক্তি নেই দেবদ্বিজে। মানুষকে বিশ্বাস করি। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন? এ দেশটার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ভক্তি, মানুষকে মাথা তুলতে দেয় না। আমার লড়াই এই নেতানো ভক্তির বিরুদ্ধে।’
‘কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি’, আমি বললাম, ‘সন্ধের পর কী করেন বললেন না তো?’
: আমার একটা অসুখ আছে। সন্ধে হলেই সেই ব্যামোতে ধরে…
: কী ব্যামো? কতদিনের পুরনো?
: তা ধরুন যৌবনকাল থেকেই রোগটার বাড়াবাড়ি। হ্যাঁ তা বছর তিরিশ-চল্লিশ হল।
: হাঁপের টান?
: আজ্ঞে না, লেখাপড়ার ব্যামো। সন্ধ্যা হলেই হেরিকেন জ্বেলে বসি পড়ি। এই আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি আর ভাবছি কখন সন্ধ্যা হবে বসব বইখানা নিয়ে। যে বইখানা পড়ছি তার শেষটুকু জানার জন্যে মন আকুলি-বিকুলি করছে।
: কী সেই বইখানা?
: ইস্পাত’। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির লেখা। পড়েছেন?
মাথা নাড়লাম। কিন্তু বলতে পারলাম না কতখানি বিস্ময়ের ধাক্কা লাগল মনে। শুধু চমকিত নয়, যাকে বলে চমৎকৃত হওয়া। খুবই আশ্চর্য। একই দেশকাল পরিবেশভেদে এক একরকম বিশ্বাসের মানুষ তৈরি হয় কেমন করে? আজকে যখন খুব দূর থেকে ভাবি তখন মেলাতে কষ্ট হয় ওয়াসেক আলীর মতো সংস্কারাদ্ধ আর সুফল সরকারের মতো মুক্তমনা মানুষকে। খুব ঘনিষ্ঠ কালের মানুষ অথচ দুজনেই। এ কেমন করে হয়? বাউল-ফকিররা আমাকে প্রায়ই যে আপ্তজ্ঞানের কথা বলত এ কি তারই উদাহরণ? আমার তো পরিষ্কার মনে হয় একবারও ঈশ্বরকে না ডেকে সুফল আত্মজ্ঞানের চরমে পৌঁছেছেন। অথচ মনের মানুষের পথের উলটো বাঁকে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা।
সেদিন শেষবিকেলে সুফল সরকার আমার জীবনে যে বড় বিস্ময়ের ধাক্কা দিয়েছিলেন তার সমাপনটুকুও কম চমকপ্রদ নয়। তাঁকে স্বভাবতই প্রশ্ন করেছিলাম সেই অজপাড়াগাঁয়ে অস্ত্রোভস্কির পৃথিবী বিখ্যাত বইখানা কোথা থেকে পেলেন? গ্রামে কি লাইব্রেরি আছে?
সুফল সরকার হালকা হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে বললেন: ‘তা হলে আপনাকে কষ্ট করে উঠতে হবে আমার ঘরের দাওয়ার একটা কোণে।’
উঠতে হল। দাওয়ার এককোণে প্যাকিং বাক্সের কাঠে তৈরি একটা সাধারণ খোলা বুকসেলফ। তাতে গোটা পঁচিশেক সোভিয়েত আর চিনা বইয়ের বাংলা অনুবাদ বই খুব যত্ন করে সাজানো। কথায় কথায় জানালেন এ সব বই অন্তত দশবার পড়েছেন। পেয়েছেন বাঁচার মন্ত্র, সংগ্রামের রসদ। ক্লাস সিক্স অবধি বিদ্যে কর্ষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্যভাবনা আর প্রগতি মন্ত্রে। ‘ইস্পাত’ বইটা হালে কিনেছেন শহরের বইমেলা থেকে।
এতক্ষণকার লুকিয়ে থাকা মানুষটা অনর্গলিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন একেবারে গর্বিত মুখরতায়। কী উদ্দীপ্ত সেই মুখভঙ্গি! ‘তেভাগা আন্দোলনের নাম জানেন? তারই ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ি হঠাৎ। সেই থেকে পড়ার নেশা। অবিশ্যি তখন কাজের চাপ খুব ছিল। সংগঠনের চাপ। তারপর দেশভাগ। কুটোর মতো ভেসে এসে প্রথমে বহিরগাছি, দশ বছর পরে এই শ্যামপুরে পাকা পত্তনি। তবু নতুন দেশে নতুন গ্রাম গড়া। সেও এক বড় সংগঠন। মানুষের সঠিক পথটা বোঝানো, সঠিক কাজটা করানো। এখন খানিকটা বিশ্রাম পাই। পরামর্শ দিই। নিজেও পড়ে পড়ে জানি অনেকটা।’
‘এ গ্রাম তাহলে আপনার কব্জায়?’ আমার জিজ্ঞাসা।
: কব্জা-টব্জায় বিশ্বাস করি না। যৌথ জীবন। সবাই খাটি, খাই। সবাইয়ের সুখে-দুঃখে সবাই দাঁড়াই। আমরা এককাট্টা।
মাঝে মাঝে ভাবি, সুফলরা কি এখনও এককাট্টা? রাজনীতির ফড়েরা এখনও সেখানে ঢোকেনি? শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের মানুষ কি সুফলের নেতৃত্ব এখনও মেনে চলেছে? কতবার ভেবেছি আরেক বার শ্যামপুর যাই। কিন্তু যাইনি। যদি তেমন আর না দেখি? মনের অতলে থাকুক একটা অমলিন বিশ্বাসের স্মৃতিচিত্র। কে আর শুদ্ধতাকে ভাঙতে চায়?
সাহেবধনী সম্প্রদায়ের সন্ধানে যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম তখন দুটো চিন্তা মাথায় ছিল। চাপড়ার বৃত্তিহুদা গ্রামে সাহেবধনীদের মূল গুরুপাট। সেখানে প্রতিদিন তাদের উপাস্য দীনদয়ালের ভোগরাগ সন্ধ্যা আরতি দেন মূল সেবাইত, আর প্রতি বৃহস্পতিবার দীনদয়ালকে দেওয়া হয় বিশেষ ভোগ ও পূজা। সেবাইত শরৎ পালকে আমি প্রথম চিন্তা থেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: ‘আপনি তো সাহেবধনীদের মূল ফকির। তা আপনাদের সাহেবধনী সম্প্রদায়ের যে অগণিত ভক্তশিষ্য চারিদিকে ছড়িয়ে আছে তাদের দীক্ষাশিক্ষা দেয় কে? সবাই আপনার কাছে আসে?’