খাড়া মানুষটা টান টান উত্তর দিলেন এক কথায়: ‘ডাকাতি হবে কেন? আমরা তো ঐক্যবদ্ধ।
খুব চমকে গেলাম। এতদিন গ্রামে ঘুরছি। সব জায়গাতেই এই ডাকাতি খুব সেনসিটিভ ইস্যু। সবাই মিইয়ে আছে আশঙ্কা আর সন্ত্রাসে। তাই জিজ্ঞেস করতেই হল; ‘তার মানে, আপনি বলছেন ঐক্যবদ্ধ গ্রামে ডাকাতি হয় না?
‘কী করে হবে?’ সুফল খুব তাত্ত্বিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘গ্রাম সমাজে সম-কাঠামো থাকলে অনৈক্য থাকে না। অসম সমাজ ডাকাত টেনে আনে। যে কোনও গ্রামে ডাকাতির ভেতরকার খবর নেবেন, দেখবেন সেই গ্রামের কোনও মানুষ নিশ্চয়ই ডাকাতদের মদত দেয়। এখানে তা হবে না।’
: কেন?
: এখানে আমরা পচিশ ঘর সাধারণ চাষি বাস করি। সবাই সাধারণ চাষি। ধান হয় সামান্য, সবজি বেশি। এই এখন যেমন জমিতে দেখবেন বেগুন টম্যাটো আর শিম। একজন চাষির জমি খুব বেশি পাঁচ বিঘে। এখানে ডাকাতিতে খরচ পোষাবে না। সামান্য চাষি দিনে গড়ে দশ-পনেরো টাকার সবজি বেচে। নিন একটু চা মুড়ি খান। একটা কালো রোগা মেয়ে চা দিল। সুফল বললেন: আমার বড় মেয়ে। পাশের দোগাছি গ্রামের হেলথ সেন্টারে কাজ করে। আজ রবিবার। ছুটি।
: তার মানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন সব। ইস্কুল আছে?
একটু হেসে সুফল বললেন: ইস্কুল ছিল না। আমি করেছি। একটা জেদ থেকে।
: কী রকম?
: তখন এখানে কিছুই ছিল না। জঙ্গল ছিল আর জলা। আগে নাকি বাঘ থাকত। আশপাশের গাঁয়ের লোক বলে। এ কথাও বলে যে আমরা পুর্ববঙ্গের লোক বাঘের থেকেও নাকি সাংঘাতিক। যা হোক আমরা ফরিদপুরের এড়াকান্দি এলাকার নমঃশূদ্র। এ গ্রামের সবাই। দেশ ভাগ হতে আমরা একটা দল চলে এসে প্রথমে বসি বহিরগাছিতে। তখন বিশ ঘর মানুষ ছিলাম। সেখানে দশ বছর থেকেও শেষপর্যন্ত টিকতে পারলাম না।
: কেন? লোকাল মানুষের শত্রুতা?
: না না। বান বন্যা। বহিরগাছি গেছেন? খুব নিচু জায়গা। প্রত্যেক বছর ভরা ফসল ডুবে যেত। শেষপর্যন্ত খোঁজ পেয়ে এখানে এসে জঙ্গল কেটে বসত গড়ি। তা পঁচিশ বছর হয়ে গেল।
সংগ্রামী মানুষের একটা দৃপ্ত কাঠিন্য আর প্রত্যয়ের ঋজুতা সুফলের চোখে। অর্থ কীর্তি সচ্ছলতার বাইরে একটা আলাদা জীবন-রস থাকে কোনও কোনও মানুষের। যেন শেকড়ের মতো সেই ব্যক্তিত্ব চারপাশ থেকে রস টেনে তুমুলভাবে বেঁচে থাকে। এমন মানুষ এখনকার গ্রামে খুব কম। মুগ্ধ চোখে জানতে চাইলাম, ‘জেদের বশে ইস্কুল খোলার কথা কী যেন বলছিলেন?’
: হ্যাঁ, সে একটা ইতিহাস। জানেন তো এদেশে এসে প্রথম প্রথম পূর্ববঙ্গের মানুষদের অনেক বিদ্রুপ ব্যঙ্গ সইতে হয়েছে। তায় আমরা সিডিউলড কাস্ট! জানেন কি আমাদের এস সি আর এস টি, অর্থাৎ সিডিউলড কাস্ট আর সিডিউলড ট্রাইব নিয়ে এদেশে আমাদের কী বলে? বলে এস সি মানে সোনার চাঁদ আর আর, এস টি মানে সোনার টুকরো। একবার শিয়ালদহ স্টেশনে টিকিটের খুব লম্বা লাইন পড়েছে, আমিও দাঁড়িয়ে আছি সে লাইনে। হঠাৎ এক কোটপ্যান্ট-পরা গৌরবর্ণ ভদ্রলোক, নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ, বললেন ব্যঙ্গ করে, ‘এ কী? এত বড় লাইন? কেন? গবরমেন্ট এখনও সিডিউলড কাস্টের জন্যে আলাদা লাইনের সুবিধা দেয়নি?’ চুপচাপ এ সবও শুনেছি। পাশের দোগাছি গ্রামে বেশির ভাগ বর্ণহিন্দুর বাস, ব্রাহ্মণপ্রধান। ওরা আমাদের বলে ‘নমো’। খুব ঘেন্না করে। তা সেবার দোগাছিতে কী একটা কাজে গেছি। গরমকাল। দু দণ্ড একটা দিঘির ধারে বসে জিরুচ্ছি। বহু লোকজন ছেলেমেয়ে বাচ্চা-কাচ্চা চান করছে, দেখছি। হঠাৎ দেখি একটা ছেলে মাঝদিঘির অথৈ জলে খাবি খাচ্ছে।
: আপনি তুললেন?
: হ্যাঁ, পুববঙ্গের জলের মানুষ। আমার সামনে কেউ ডুবতে পারে? সাঁতরে গিয়ে ছেলেটাকে তুলে আনলাম। খুব জল খেয়েছিল। ঘুরপাক খাইয়ে জল বার করে দিয়ে বললাম ‘যাঃ বেঁচে গেলি।’ খবর পেয়ে খানিকগর ছেলেটার মা ঠাকুমা ছুটে এল। খোঁজ নিল কে বাঁচিয়েছে তাদের ছেলেকে। সবাই আমাকে দেখিয়ে দিল। বুড়ি বলল, ‘তুমি শ্যামপুরে থাক না?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই তার নাতির নড়া ধরে বলল, ‘চল। জলে ডুব দে। তোকে নমোয় ছুঁয়েছে।’ কেউ প্রতিবাদ করল না। সবাই সায় দিল।
: বলেন কী?
: হ্যাঁ। সেদিন জেদ ধরল মনে। বুড়ি, শুধু তোমাকে নয়, তোমাদের দোগাছির সবাইকে আমি নমোর শক্তি দেখিয়ে দেব। তা দেখিয়ে দিয়েছি। এখন ও গ্রামে আমার খুব মান্যতা। সবাই তোয়াজ করে বলে সুফলবাবু আমাদের গর্ব।
: কীভাবে তা হল?
: গ্রামকে সংঘবদ্ধ করলাম। শহরে ছোটাছুটি করে নাইট স্কুল করলাম। এখন আমাদের গ্রামের সবাই প্রাথমিক পাশ। অন্তত চারটে গ্রাজুয়েট। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বিশজন ছেলে-মেয়ে। সবাইকে শিক্ষিত করব। সবাই এখানে এককাট্টা।
এতক্ষণে মানুষটার অহংকারের কারণ বুঝলাম। শুধু সুফল নয়, সফল। কিন্তু গ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে কী করে? এখনও পাটিবাজি ঢোকেনি? পশ্চিমবঙ্গের এমন গ্রাম তো দেখিনি যেখানে দলীয় রাজনীতির সংঘর্ষ নেই। পঞ্চায়েত তো আছে। ভোটও আছে। তবে? কথাটা আমাকে শেষপর্যন্ত জিজ্ঞেস করতেই হল।
সুফল বললেন: ‘এখানকার বেশির ভাগ গ্রামের রাজনীতি ব্যাপারটা অন্তঃসারশূন্য আর হুজুগে। একটা ঘটনা শুনবেন? ওই দোগাছির পাশের গ্রাম মূর্তিপুর। সেখানে দু ভাই সুকেশ আর জনার্দন মণ্ডল পৃথগন্ন হয়ে পাশাপাশি বাস করে। সামান্য জমি আছে চাষ-আবাদ করে। কোনওরকমে চলে যায়। দুজনেই সি পি এম করে। কারুরই অবশ্য রাজনৈতিক জ্ঞান নেই। তো মূর্তিপুরে সি পি এম আর এস পি-তে খুব রেষারেষি। দু দলই চেষ্টা করছে ক্যাডার বাড়াতে। একদিন সুকেশ আর জনার্দন দুজনেই যখন মাঠে তখন সুকেশের গোরু জনার্দনের বেড়া ভেঙে এসে উঠোনের ফসল খেয়ে গেছে। বেধে গেল দুই বউয়ে তুমুল ঝগড়া। তারপর তেতেপুড়ে জনার্দন বাড়ি ফিরতেই তার বউ তাকে সাতকাহন করে লাগাল। সঙ্গে চোখের জলের অস্ত্র। বাস, আগুন জ্বলে গেল জনার্দনের মাথায়…