জেলা কৃষি আধিকারিক নেমন্তন্ন করেছিলেন বার্ষিক পুরস্কার বিতরণের উৎসবে। জেলার সফল চাষিদের দেওয়া হবে শীল্ড আর কাপ। কেউ পাবে ভাল ফলনের জন্য, কেউ ভাল সাইজের জন্য, কেউ একই জমিতে একাধিক ফলনের জন্য। যদিও রুটিন প্রোগ্রাম তবু আমি সাধারণত এ সব সভায় যোগ দিই গ্রামের অন্য ধরনের মানুষ দেখার লোভে। গুরু-মন্ত্র কবচ-তাবিজ, আখড়া-শব্দগান-কিংবদন্তি-অন্ধবিশ্বাস, মেলা-মচ্ছব-বাউল-বৈরাগী-উদাসীনদের খুঁজতে গিয়ে গ্রাম-জীবনের অন্য বাঁকটাও দেখেছি বইকী। যে দিকটা ফলবান, যেদিকে অবিচার শোষণ, যে-মানুষ বঞ্চিত। আবার অগাধ ধানপাট, বিশাল জমিতে ট্রাক্টর চলছে, মাঠে মাঠে শ্যালো টিউবওয়েলের জলের কল্যাণে শস্যসম্ভারের শ্যামশ্রীও আমি অনেক দেখেছি। রবিফসলের সময় আমি গ্রামের মানুষকে পেট পুরে খেতে দেখিনি কি? সেই আমিই আবার দেখেছি গ্রামের মুদির দোকানে দেশলাই কাঠি খুচরো বিক্রি হতে কিংবা একটি মেয়ে মুদির দোকানে এসে একটা ছোট পুঁটলি নামিয়ে তিসির বিনিময়ে নিয়ে যাচ্ছে কেরোসিন তেল।
তবে গ্রামের পরিবেশে তাদের দেখা একরকম আর শহরের সম্মেলনে আরেক রকম। এই সব কৃষি আধিকারিকের সভায় একপাশে বেঞ্চিতে বসে থাকে কিছু চাষি। নিজেরা যাদের পরিচয় দেয় চাষাভুষো বলে, আকাশবাণী তাদের বলে চাষিভাই। এমন অনুষ্ঠান ইন্ডিয়ান নিউজ রিভিয়ুতে অনেক দেখেছি। সাধারণত হরিয়ানার সহাস্য পেশল পাগড়িপরা চাষিদের এ সব তথ্যচিত্রে দেখি। সেদিনকার পুরস্কার বিতরণ উৎসবে আমাদের ন্যুজ মলিন ক্লান্ত কৃষকদেরই দেখব জানতাম। কিন্তু সেই আশাহীন মানুষের ভিড়ে একজন খাড়া মানুষকে দেখে চমকে যাই। তিনিই সুফল সরকার, পরে জানতে পারি। এক জমিতে বহু ফসলের পুরস্কারের প্রাপক ছিলেন তিনি। সে কথা ঘোষণায় শুনি। কিন্তু তার আগে সুফলের একটা কথা আমাকে টানে।
টেবিলে পর পর সাজানো ট্রফি, অভিজ্ঞানপত্র আর সেভিংস সার্টিফিকেট। সভাপতি হিসাবে জেলাশাসক এসে গেছেন তাঁর রেডিমেড হাসি নিয়ে। পাশে তাঁর রোদ-চশমা পরা খরগোশের মতো তুলতুলে বউ। তাঁদের অতি-পরিকল্পিত সংসারের একতম শিশু সন্তানটি গ্যাজেবো পোশাক পরে ডি. এমের খাস আর্দালির কাঁধে চড়ে দন্তবিকশিত আননে সবাইকে কৃতার্থ করছে। ডি. এমের সামনে জেলা কৃষি আধিকারিক বিগলিত হেসে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যান্য সহ-আধিকারিকেরা নানা তদ্বির তদারকে ব্যস্ত। মঞ্চে নানাজাতীয় পোস্টার। প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ও রাজ্য কৃষিমন্ত্রীর আশীর্বাণীমণ্ডিত স্যুভেনির একটা পাওয়া গেল যার সর্বাঙ্গে জেলার সমস্ত সার ও পাম্পসেটের দোকানের কিম্ভুত নামাবলী। একপাশে বেঞ্চিতে বসে নিমন্ত্রিত চাষিরা। এ উৎসব নাকি তাদের। পরনে তাদের বে-আন্দাজি মাড় দেওয়া ঠেটি ধুতি আর শার্ট। খড়ি-ওঠা বেঢপ শক্ত পায়ে ধুলোধূসর বুটের অনিচ্ছুক অবস্থান। কিন্তু রোদ-পড়া কালো মুখে সেই প্রার্থিত সাজানো হাসি যে নেই! সরকারি স্ট্রিনজেন্ট ফোটোগ্রাফার তাদের সামনে ক্যামেরা ধরেছে আর বলছে: কই, একটু হাসুন।
সঙ্গে সঙ্গে একসটেনশন অফিসাররা এসে বললেন: হাসুন হাসুন। আজকে আপনাদের কত আনন্দের দিন। কত প্রাইজ পাবেন। একটু হাসি হাসি মুখে তাকান এইদিকে।
ঠিক এই সময়ে উঠে দাঁড়ালেন সুফল সরকার। কালো রঙের খাটো মানুষ। মালকোঁচা-মারা ধুতি আর শার্ট পরনে। খুব তেজালো গলায় বললেন: ‘হাসিটা আসবে কোথেকে বলুন তো? ভোরবেলা বি. ডি. ও সায়েব গ্রাম থেকে ধরে এনেছেন। খিদেয় হাঁ হাঁ করছে সবাই। এ মশায় চাষার খিদে, জষ্টি মাসের খেতের মতো। ও আপনাদের চা-বিস্কুটের কম্মো নয়। পেট পুরে খাওয়ান আপনি হাসি ফুটবে। করছেনটা কী আপনারা? শুধু ব্যাজ লাগিয়ে ফুটুনি আর বড় বড় কথা।’
এই এক বাক্যবন্ধের স্পষ্টতায় ভাল লেগে গেল সুফল সরকারকে। চমৎকার সোজা লোক। আলাপ না করে উপায় আছে। আলাপের শেষে কথা আদায় করলেন তাঁর গ্রামে একদিন যেতেই হবে। শ্যামপুর।
মনে আছে দিন সাতেকের মধ্যেই গিয়েছিলাম। শীতকাল। বাসস্টপ থেকে নেমে শুরু হল হাঁটা। দুপাশে শস্যকীর্ণ মাঠ। ‘অবারিত’ আর ‘আদিগন্ত’ শব্দ দুটোর ঠিক মানে গ্রামে এলে তবে বোঝা যায়। পথের দুপাশে কদাচিৎ একটা-দুটো মেটে বাড়ি। আখ মাড়াই চলছে। ঘরের দাওয়ায় পাটকাঠিতে গোবর লাগিয়ে জ্বালানি রোদে শুকোচ্ছে।
‘কোথায় যাবেন? পথ-চলতি মানুষের জিজ্ঞাসা।
‘সুফল সরকারের বাড়ি।’
‘সোজা গিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেবেন। মিনিট দশেক লাগবে। সুফলদা বাড়িতেই আছেন। এই তো কথা বলে এলাম।’ মানুষটির মুখে সুফল সম্পর্কে সন্ত্রমটুকু গোপন ছিল না।
খানিক পরেই পৌঁছে গেলাম। অনতিপ্রৌঢ় মানুষটা উঠোনে বসে খেজুরপাতার চ্যাটাই বুনছিলেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বসতে দিলেন একটা পালিশছাড়া কাঁঠাল কাঠের চেয়ারে। নিজে রইলেন দাঁড়িয়ে। তবে মানুষটা খুব ছটফটে। এই পা দিয়ে আঁচড় কাটছেন মাটিতে, এই খানিকটা এ পাশ ও পাশ করছেন। সারাক্ষণ চঞ্চল চোখদুটো ঘুরছে। খুব সতর্ক অথচ উৎসুক। খানিকক্ষণ দুপক্ষেই ধানাইপানাই আমড়াগাছি হল। অবশেষে এই শান্ত ছিমছাম গ্রাম সম্পর্কে সবচেয়ে রোচক প্রশ্নটা তুললাম: ‘কেমন আছেন এই গাঁয়ে? মনে তো হল বেশ ফসল হয়। মানুষজনও শান্তশিষ্ট পরিশ্রমী। মাঠে মহলায় সবাই খুব কর্মব্যস্ত। কিন্তু এই পরিবেশ কি সত্যি? পাটিবাজি নেই? ডাকাতি হয় না?’