শেষপর্যন্ত ওয়াসেফ আলীকে অনেকক্ষণ থেকে আটকে থাকা কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম: ‘আহাদ শাহকে মার্ডার করলে কে? কেনই বা? এর মধ্যে কি হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার আছে নাকি কিছু?’
: আরে না না। খানিকটা হিংসা দ্বেষ খানিকটা লোভ। এ কথাটা ঠিকই যে গুরুর নামডাক আর ক্রিয়াকলাপের খবর দূর দূর গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটাও সত্যি যে তাঁর কৃপায় রোগ সেরে যাচ্ছিল অনেকের। তার ফলে কী হল? এই আশ্রমের চার পাশে যত জমি আর বাগান দেখছেন এ সবই ভক্তজনেরা তাঁকে লিখে দিতে লাগল। সে সব কি নীচ মানুষের ঈর্ষা হিংসা জাগায়নি? কিন্তু তাতে তো একটা লোককে খুন হতে হয় না।
: তবে কি ওঁর ধর্মমত কাউকে চটিয়েছিল?
: না। তাও তো নয়। তাঁর ধর্মমত খুব উদার ছিল। এখনও এখানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান অম্বুবাচীর মচ্ছবে একসঙ্গে খানা খায় পাশাপাশি বসে। আসবেন দেখবেন। তিনি বলতেন—‘হক-আল্লা বলো মুসলমান, হক-হরি বলো হিন্দু, হক-যিশু বললা খ্রিস্টান।’ এই কথা সর্বদাই বলতেন। হক মানে তো সত্য। সত্যকে তো সবাই চায়। আসলে আমি যা বুঝি, ও সব ধর্ম নয়, ঈর্ষা হিংসা নয়, তাঁকে মরতে হল একদল মানুষের অন্যায় লোভে।
: ব্যাপারটা একটু খুলেই বলুন।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওয়াসেফ বললেন: ‘সে আমাদের খুব দুঃখের ঘটনা। সেদিন সন্ধ্যার আগে ফকির সাহেব বিশেষ কারণে কিছু টাকা ভক্তদের দেন। তাদের মধ্যে কজন ভক্ত বোধহয় ভেবেছিল তাঁর কাছে অনেক টাকা আছে। রাতের বেলা তারা এসে ফকিরের কাছে সব টাকা চাইল। তিনি সবই দিলেন তবু তারা বলল, আরও টাকা দিতে হবে। তারা বাঁধল তাঁকে। তাদের বোধহয় চিনতে পেরেছিলেন গুরু। তাই বুকে ছুরি বসিয়ে দিল। ফকির বলেছিলেন অনুনয় করে, ‘আমাকে জানে মেরো না।’ তারা শুনল না।’
সজল চোখে ওয়াসেফ বললেন: ‘আমার কপাল, আমিই প্রথম তাঁকে দেখি। খুব ভোরবেলা। তখনও প্রাণ ছিল। রক্তের বন্যায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছেন। আমিই দড়াদড়ি খুলে দিই। সে রাতেই প্রাণ চলে গেল তাঁর। কিছুতেই, শত অনুনয়েও খুনিদের নাম বললেন না। ক্ষমা করলেন তাঁদের। তবে আল্লা তো তাদের ক্ষমা করেননি। উচিত বিচার হয়েছে।’
: কী রকম?
: সে কি আপনার বিশ্বাস হবে? তবে আমরা নিজে দেখেছি একজন লোক এই আশ্রমেই বক্তবমি করে মরল। কজন চুরি করা টাকা ফেরত দিয়ে আশ্রমের বেদীতে মাথা ঠুকে ঠুকে ক্ষমা চাইতে লাগল আকুল হয়ে। সূর্যাস্তের আগেই তারা ছটফট করে ম’ল। বাকি যে সব খুনি ছিল মাসখানেকের মধ্যে সবাই অপঘাতে শেষ হল। হঠাৎ হঠাৎ আশপাশের গাঁ-ঘরে কজন মরে গেল। আপদ চুল। সেই থেকে এই আশ্রমের নামডাক খুব ছড়িয়ে পড়ল। অম্বুবাচীর মেলায় ভক্ত ভক্ত্যাদের ভিড় বেড়েই চলল। এখন তো হাজার পঞ্চাশ লোক আসে।
জানতে ইচ্ছে হল আহাদ ফকির কত বছর বয়সে নিহত হয়েছিলেন? সে কি অকালে? তখন কি তিনি নিতান্ত নবীন?
ওয়াসেফ বললেন: ‘তাঁর জন্ম সাল ১২৪৬ সন, এন্তেকাল ১৩৫৬। তার মানে ১১০ বছর তিনি বেঁচেছিলেন।’
আমি বললাম: এমন একটা মানুষ মরে গেল। মামলা-মোকদ্দমা হল না?
: কাকে নিয়ে হবে? সাক্ষী তো ছিল না কেউ। তা ছাড়া ফকির তো কারুর নাম বলে যাননি। তবে খোদ খোদার আদালতে হয়ে গেছে বিচার। সে সব খুনি পাপীদের নাম কি আজ আর কেউ করছে? সবাই ভক্তিভরে আহাদের নামই করে, তাঁরই গুণ গায়। এই যে আপনি এতদূর থেকে এয়েছেন সে তো তাঁরই কথা শুনতে নাকি কহেন?
আমি দেখতে থাকি এই ঐশী জায়গা। সন্দিহান মন আমার সাড়া দেয় কই? আমার জড়বুদ্ধি মেয়ের জন্যে এখানে হত্যে দিলে সে সেরে উঠবে? ঘুচবে তার পঙ্গুত্ব? ফিরবে তার বোধ? কথা বলবে সে? আমাকে ডাকবে সে ‘বাবা’ বলে? সে ডাক যে তার মুখে আমি কখনও শুনিনি! হে আহাদ ফকির, আমাকে বিশ্বাস দাও। তোমাকে ভরসা করবার মতো বিশ্বাস। লোকায়ত জীবনে আমি কখনও অলৌকিক দেখিনি। দুবরাজের মতো আমি তোমাকে আকুল হয়ে ডাকতে পারিনা। ওয়াসেফের মতো অটল বিশ্বাস নেই আমার। দু চোখ কি বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে আসে?
না মুহুর্তে যুক্তিবাদী মন শক্ত হয়ে ওঠে। বিশ শতকের শেষ দিকে দাঁড়িয়ে এ আমার কী সব উলটো ভাবনা। আমার বুদ্ধিজীবী মন ভাবতে থাকে আহাদের চমৎকার মিথটুকুর সারবস্তু নিয়ে। ভাবি, জীবনে যে-মানুষটি ছিল অনতিখ্যাত, এক অকারণ হনন তাঁকে করেছে লোককথার বিখ্যাত কেন্দ্রবিন্দু। আততায়ীদের সকলের মৃত্যুঘটনা তাঁকে দিয়েছে অলৌকিক কিংবদন্তির দুর্লভ অবিস্মরণীয়তা। এমনিই কি চলবে চিরকাল? পৃথিবী এগিয়ে চলবে এবং সভ্যতা। আণবিক যুগ তৈরি করবে অবিশ্বাস্য পৃথিবী, বৈদ্যুতিন কৃৎকৌশল রিমোট কনট্রোলে চালাবে যান্ত্রিক সমাজজীবন। আহাদদের গল্প তখনও থাকবে? বিশ্বাস করবে মানুষ সে সব?
হঠাৎ সমস্ত আশ্রমটা আমার সামনে বিস্ফোরিত হয়ে গেল। যেন অন্তহীন ব্যর্থ রিক্ত মানুষের নিস্ফল মাথাকোটা এখানে দারুণ শ্বাস ফেলছে। যেন আমার মেয়ের মতো ভারতের পাঁচ লক্ষ জড়বুদ্ধি সন্তান মুক্তি চাইছে অসহায় জীবন থেকে নিষ্ক্রমণের জন্যে। হতবাক আমার কাঁধে হাত রেখে বদ্ধ ওয়াসেফ বললেন: ‘আপনার কষ্ট আমি বুঝছি। আপনার মধ্যে ভক্তি নেই। আপনি কোনওদিন শান্তি পাবেন না।’
আমি অভিমান ভরে মাথা তুললাম আর মনে পড়ল সুফল সরকারের প্রত্যয়ভরা মুখখানা। সেইসঙ্গে তার তেজোদীপ্ত কথা: ‘এ দেশটার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ভক্তি। মানুষকে মাথা তুলতে দেয় না। আমার লড়াই এই নেতানো ভক্তির বিরুদ্ধে।’ কথাটা মনে পড়া মাত্রই আমি শ্যাওড়াতলা ত্যাগ করলাম খুব দ্রুত পায়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওয়াসেফ আর আহাদের বিশ্বাসী ভক্তের দল। আমি নদী পেরিয়ে সোজা বাসে উঠলাম। খানিকক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দিল। আমার মন রোমন্থন করতে চাইল সুফল সরকারের সঙ্গে প্রথম দেখার দিনটির ঘটনাগুলো।