এরপরে ভোর থেকে আমার শুধু দেখে যাওয়া। কেননা ফকির নির্বাক। সকালে সদলে গঙ্গাস্নান সেরে আসনে বসলেন ফকির। সাদা বেশবাস। মাথায় চাদরের ঘোমটা। একহাত দিয়ে বুকে ধরে আছেন ফকিরি দণ্ড। সামনে সিঁদুৱলিপ্ত এক বিরাট ত্রিশূল, তার সামনে রক্তাম্বরধারী এক সেবক। ‘জয় দীনদয়াল গোপ্ত বাবাজী’ হুংকার দিয়ে রাশি রাশি পুজোপচার নিয়ে পুরুষ নারীরা ভুলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম জানাচ্ছে। দেখতে দেখতে জায়গাটা বিশ্বাসী ভক্তে ছেয়ে গেল। কয়েকশো লোক ভেজা কাপড়ে হত্যে দিয়ে পড়ে রইল। জায়গাটা কাদায় কাদা। উঁকি মেরে দেখলাম ফকির সংযত ভঙ্গিতে বসে আছেন। সামনে পাতা একটা নতুন পাটি। তাতে জমা পড়ছে খুচরো পয়সা আর টাকা, কাঁচা আর নোট। লাল খেরোর খাতা খুলে এক গোমস্তা হিসেব লিখছেন।
গোপালের মাকে জিজ্ঞেস করে পরে জানলাম ওই খাতায় আসুনে ফকিররা খাজনা জমা দিচ্ছে।
: খাজনা কীসের? আমার প্রশ্ন।
গোপালের মা বলে, ‘কেন বাবাঠাকুর, ওনাদের দেহমন তত দীনদয়ালের ঘরে বাঁধা। তার খাজনা দিতে হবে না?’
: কত করে খাজনা?
: তার কি কোনও ঠিক আছে? যার যেমন ক্ষমতা। টাকা আধুলি চাল ডাল মটর খন্দ কলাই। ওই দিয়েই তো অন্ন মচ্ছব হবে। আবার বোশেখী পুন্নিমেতে হুদোয় হবে মচ্ছব। তখন এখানকার সব আসুনে ফকির সেখানে যাবে। দীনদয়ালের ঘর থেকে তাদের দেওয়া হয় পাটি আর হুঁকো।
ভাবতে লাগলাম বিচিত্র ধর্ম, বিচিত্র তার রীতি আর আচার। কিন্তু কতদিন আর থাকবে? গুরুকুলে টাকার টান পড়েছে। মন্ত্রতন্ত্র জমাবন্দি হয়ে আছে সিন্দুকে। চর্চার অভাবে ভেষজ বিদ্যা ভুলে গেছে পালেরা। শরৎ ফকিরের ছেলেরা পড়ছে স্কুল কলেজে। কৌলিক ফকিরি তারা নেবে না। বড়জোর বছরে একবার আসবে অগ্রদ্বীপে কিছু রোজগারের ভরসায়।
দেখতে দেখতে বেলা গড়াল। ফকিরের সামনের মাদুরে স্তূপের মতো জমা হতে লাগল টাকা পয়সা আর চাল ডাল আলু এঁচোড়। একদল সম্প্রদায়ী দশ-পনেরোটা মাটির হাঁড়িতে চড়িয়ে দিল রান্না। গাছতলা ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। তার মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় গোপালের মা পরম নিষ্ঠায় পাতল এক বিচিত্রিত মানুষ সমান কাঁথা। তাতে রাখল একটা বালিশ। কাঁথার মাথার কাছে পাটের কাঠি দিয়ে ছোট্ট একখানা ঘর বানিয়ে সেটা ঢেকে দিল লাল কাপড়ে। কঞ্চিতে এক গেরুয়া নিশান লাগিয়ে দিল পুঁতে।
ব্যাপার দেখে আমি তো অবাক। তা বুঝতে পেরে গোপালের মা বললে, ‘ও ছেলে, এটা হল কুবির গোঁসাইয়ের আসন। তেনার প্রকট কালে চরণ পাল আসন পাততেন ওইখানে যেখানে ফকির বসেছেন আর এইখানে বসতেন কুবির বাবাঠাকুর। তাঁর বংশে তো শিক্ষাদীক্ষা রইল না। আমার ছেলে গোপাল তো অবোধ। তাই আমি বাবাঠাকুরের আসনটুকু পেতে রাখি। উনি এসে দুদণ্ড বসেন গুরুর সামনে। ওই তো এখন শরৎ ফকিরের মধ্যে চরণ পাল এয়েচেন। এখন ওঁর চোপর দিন কথাবাত্তা জ্ঞানবুদ্ধি বাহ্যে পেচ্ছাব সব বন্ধ। এখানেও কুবির বসে বসে গুরুকে নেহার করছেন। বাবা চরণ পালের নামে একবার হরি হরি বল। জয় দীনদয়াল গোপ্ত বাবাজী।’
সমস্ত মেলার মানুষ যেন জোকার দিয়ে উঠল। দারুণ এই বিশ্বাসের জগতে আত্মবিচ্ছেদে জর্জর আমি এক সংশয়ী। ভয়ানক বেমানান। তার থেকে ত্রাণ পাবার জন্যই বোধহয় গোপালের মাকে বললাম: এই সময় তুমি বরং কুবিরের একখানা গান ধরো।
: ঠিক বলেছো বাবা। তবে তাঁর সেরা গানখানাই শোনো। এ গানে আমাদের দীনদয়ালের ঘরের আসল কথা কটা আছে। শোনো—
মানুষের করণ করো
এবার সাধন বলে ভক্তির জোরে মানুষ ধরো।
হরিষষ্ঠী মনসা মাখাল
মিছে কাঠের ছবি মাটির ঢিবি সাক্ষীগোপাল
বস্তুহীন পাষাণে কেন মাথা কুটে মরো?
মানুষে কোরো না ভেদাভেদ
করো ধর্মযাজন মানুষজন
ছেড়ে দাওরে বেদ।
মানুষ সত্যতত্ত্ব জেনে মানুষের উদ্দেশে ফেরো।
ঘটে পটে দিওনারে মন
পান করো সদা প্রেমসুধা অমূল্যরতন।
গোঁসাই চরণ বলে কুবির চরণ যদি চিনতে পারো ॥
ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যায় যাদুবিন্দুর নাতির ছেলে দেবেন গোস্বামীর সঙ্গে। ‘কই আমাদের পাঁচলখিতে তো এলেন না’—অনুযোগ ফুটল। সেইসঙ্গে আক্ষেপ, ‘আর যাবেনই বা কোথায়? ভিটেটুকু আর যাদুবিন্দুর সমাজ ঘর ছাড়া আর আছে কী? সেবাপুজো করার পয়সা জোটে না। নতুন শিষ্যশাবক হয় না। পুরনোরা গরিব। আর চলে না।’
: রোজগারের অন্য পথ কিছু নেই?
: সামান্য বিদ্যে সম্বল। সাতজন পোষ্য। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। জ্বরজারি। যেদিন শরীর ভাল থাকে কালনা কোর্টে গিয়ে দলিল দরখাস্ত লিখে দুচার টাকা পাই। তবু যাবেন একদিন। যাদুবিন্দুর গানের খাতা আছে পাঁচখানা। বাবু, ও সব বিক্রি হয় না? কোনও দাম নেই?
দেবেন গোঁসাইয়ের চোখমুখ লাল টকটকে। রোদে না জ্বরের তাড়সে?
রাতে শরৎ ফকিরকে দেবেনের প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘মানুষটা ভাল, তবে বড় দুঃখী। বিরাট বংশের ছেলে। যাদুবিন্দুর তো অনেক শিষ্য ছিল। ধরে রাখতে পারল না। দীনদয়ালের ঘরের শিক্ষা ঠিকভাবে ধরে রাখতে না পারলে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। ওর তো পাঁচ-ছজন সন্তান। সংযম নেই। জন্ম-পাকে পড়ে গেছে। তবু দেখবেন যদি কিছু করতে পারেন। টাকার খুব টানাটানি বেচারার। আমার সমস্যা অন্য। দীনদয়ালের ঘরই বোধহয় রাখতে পারব না। আধুনিক যুগে নতুন শিষ্য আসছে না। নেহাত পঞ্চাশ বিঘে দেবোত্তর জমি আছে, তাই ঠাকুর সেবাটা চলবে।’