- বইয়ের নামঃ গভীর নির্জন পথে
- লেখকের নামঃসুধীর চক্রবর্তী
- প্রকাশনাঃ নন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
০. আত্মপক্ষ – গভীর নির্জন পথে
গভীর নির্জন পথে – সুধীর চক্রবর্তী
প্রথম সংস্করণ: জুলাই ১৯৮৯
দ্বিতীয় সংস্করণ: জুলাই ২০০২
.
বাবা ও মা-র পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে
.
‘গ্রাম-গ্রামান্তর ক্ৰমে চূর্ণ হবে শাখা-প্রশাখায় বর্ধমান শহরের পদক্ষেপে।
যত কলরব পাখির, দিঘির আর গাছের পাতার, ডুবে যাবে।
সেই দুর্দৈবের আগে যাও গ্রামে গ্রামে।
ধুলোয় কাদায় এখনও অনেক কিছু পাবে গান প্রাণ শিল্পের সম্ভার।
মহানন্দে তুলে নাও, ঐতিহ্যকে চিনে রাখো।’
অরুণকুমার সরকার
.
আত্মপক্ষ
প্রস্তুত লেখাগুলির সূচনা ঘটেছিল ১৩৯১ বঙ্গাব্দে শারদ সংখ্যা ‘এক্ষণ’ পত্রে। নাম ছিল ‘মনের মানুষের গভীর নির্জনপথে’। পরবর্তী দু বছরের শারদ সংখ্যা ‘এক্ষণ’ পত্রে ‘গভীর নির্জন পথে’ নামে আরও দুটি কিস্তি প্রকাশ পায়। তা ছাড়া ১৩৯১ থেকে ১৩৯৩ বঙ্গাব্দের তিন সংখ্যা ‘বারোমাস’ পত্রে বেরোয় তিনটি আলাদা অংশ সম্পূর্ণ আলাদা শিরোনামে। এখন গ্রন্থরূপ দেবার সময় মোট দুটি অংশ নতুনভাবে বিন্যস্ত হল। সব মিলিয়ে আসলে একটিই লেখা, একই অভিপ্রায়কে ধরতে চাওয়া।
‘এক্ষণ’-সম্পাদক প্রীতিভাজন বন্ধু নির্মাল্য আচার্য এবং ‘বারোমাস’-সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন অশোক সেন বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ করেছেন লেখাগুলি ধৈর্যের সঙ্গে মুদ্রণ করে। লেখা পড়ে পত্র মারফৎ ফকিরদের সম্বন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং কয়েকটি আরবি-পারশি শব্দ সম্পর্কে ভ্রম সংশোধন করে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন কথাসাহিত্যিক। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। লেখাগুলি যাঁরা ধারাবাহিক আগ্রহ বজায় রেখে পড়ে নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন এবং বইটি প্রকাশের ব্যাপারে যাঁদের সক্রিয় সহযোগ রয়েছে তাঁদের শুভেচ্ছা জানাই।
সব দিক ভেবে কয়েকটি স্থাননাম ও ব্যক্তিনাম একটু পালটে দিয়েছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থান ও ব্যক্তিনাম হুবহু আছে। তবে সবচেয়ে অমীমাংসিত থেকে গেল লেখাগুলির জাত বিচারের সমস্যা। কেউ ভাবতে পারেন এগুলি কাহিনীমূলক, অন্য কেউ ভাবতে পারেন অন্য কিছু। ‘এক্ষণ’-সম্পাদক লেখাগুলি পত্রস্থ করেছিলেন ‘প্রবন্ধ’ বলে। তাঁর নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল প্রবন্ধের এও একটা ধরন। তাঁর মনোভাবে আমার সায় আছে।
সুধীর চক্রবর্তী
৮, রামচন্দ্র মুখার্জি লেন
কৃষ্ণনগর, নদীয়া ৭৪১১০১
১.১ মনের মানুষের গভীর নির্জন পথে
শোনা যায় যান্ত্রিক সভ্যতা যত এগোয় সভ্য মানুষ তত কৃত্রিম হতে থাকে। তার মুখে এঁটে বসে যায় এক মুখোশ—শিষ্টতার, সৌজন্যের। পরে অনেক চেষ্টা করলেও তার সত্যিকারের মুখশ্রী আর দেখা যায় না, সে নিজেও এমনকী দেখতে পায় না। বলা হয় গাঁয়ের মানুষ নাকি অন্যরকম। সভ্যতার কৃত্রিমতার আঁচ যদিও তাদের গায়ে লাগছে একটু আধটু, তবু তারা সরল প্রাণবন্ত আতিথ্যপ্রবণ।
এ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা মিশ্র ও ভিন্নতর। অন্তত শতকরা আশিভাগ গ্রামবাসীর মনের কথা টের পাওয়া যে খুব কঠিন তা আমি বলতে পারি। তাঁদের মুখে মুখোশ নেই কিন্তু আছে এক কাঠিন্যের আবরণ। আপাত সারল্যের অন্তরালে সেই কঠিনতা প্রায় দুষ্প্রবেশ। তবে একবার সেই শক্ত খোলা ভাঙতে পারলে ভেতরে নারকোলের মতোই বড় স্নিগ্ধ শাঁসজল। কয়েক শতাব্দীর তিক্ত লেনদেন, ব্যর্থ আশ্বাস আর নির্লজ্জ শোষণ গাঁয়ের মানুষকে শহুরে বাবুদের সম্পর্কে করে তুলেছে সন্দিহান। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁদের দেখা-জানা আর শহরের মানুষের বইপড়া-তত্ত্বে এত ফাঁক তাঁরা দেখতে পান যে আমাদের জন্যে তাঁরা সবসময়ে রেখে দেন এক অন্তর্লীন করুণাবোধ। তাঁদের মৃঢ় ম্লান মূক মুখে ঢাকা আছে এক দারুণ কৌতুক, যার বিনিময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে করেন অবসর সময়ে। তাঁদের এই কৌতুক আর করুণা প্রকাশ পায় বাক্যে। ‘বাবুর কি আমাদের মোটাচালে পেট ভরবে?’ ‘এ গেরামে কী আর দেখবেন? গরমকালে ধুলো আর বর্ষাকালে কাদা’—কিংবা ‘বাবু হঠাৎ টেপ রেকর্ডার যন্তর নিয়ে অ্যালেন যে? আমাদের গেঁয়ো গানে কি আপনাদের মন ভরবে?’ অথবা ‘আপনারা এদিকে ঘন ঘন এলে আমাদের ভয় লাগে, হয়তো ভোট বা অন্য কোনও তালে আসছেন কে জানে?’ এ সব বাক্যবন্ধে খুব কায়দা করে মেশানো আছে চাপা কৌতুক আর নীরব অট্টহাসি।
লোকসংস্কৃতি বিষয়ে যাঁর সরেজমিন ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে তিনিই বুঝবেন আমার ধারণার মূল কথা। একটা দারুণ প্রতিরোধ আর অবিশ্বাস তাঁদের পার হতে হয়েছে। সেখানে, অভ্যর্থনা জোটে, আহার বাসস্থানও। কিন্তু সন্দেহ থাকে সদা উদ্যত। একটা ভয়—এই বুঝি কিছু বেরিয়ে গেল তাঁদের। ‘জানেন আমাদের গাঁয়ের কুবির গোঁসাইয়ের গান টুকে নিয়ে যষ্ঠী ডাক্তার রেডিওতে দিয়েছিল, কত টাকা পেয়েছে!’ ছেঁউরিয়ায় লালন ফকিরের মাজারে আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘জানেন, আপনাদের রবি ঠাকুর আমাদের লালন শা-র গান টুকে নোবেল প্রাইজ না কি যেন একটা পেয়েলো। সে নাকি শতাবধি টাকা!’
এ যদি হয় সাধারণ মানুষের বক্তব্য আর ধারণা তবে অসাধারণদের অব্যক্ত বিশ্বাস আর নাই বা বললাম। কিন্তু আমার কাজটা ছিল আরও কঠিন জায়গায়। উদাসীন ফকির বাউলদের সঙ্গে। সময়টা পুরো ষাটের দশক। নদীয়া-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ এ বাংলায়, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া ও বাংলায়। অনেক অগণন গ্রাম। তার মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা কত উপধর্ম। এইচ. এইচ. উইলসন যাঁদের একশো বছরেরও আগে বলেন ‘মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টস’, অক্ষয়কুমার দত্ত যাদের বলেন ‘উপাসক সম্প্রদায়’। একশো বছর আগে লেখা তাঁদের বিবরণ পড়ে জানতে ইচ্ছে হয় এখন কী অবস্থায় আছে এ সব সম্প্রদায় বা উপধর্ম? শুরুতে আমার সম্বল বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুঁথিপড়া ডিগ্রি আর জানবার প্রবল আগ্রহ। কিন্তু ভাষা যে জানি না! সত্যিই তাই। লোকধর্মের ভাষা বুঝতে আমার লেগেছে ঝাড়া পাঁচটা বছর। কেননা তাদের ভাষ্যটাই ‘সন্ধা’ অর্থাৎ বাইরের মানে আর ভেতরের মানে একেবারে আলাদা। প্রথমদিকের হোঁচট খাওয়ার কিছু নমুনা বলি।