সাঁকোর মাঝখানে স্তব্ধ-বিস্ময়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করলাম এত ভোরে কে আসতে পারে। আমার ঘরের ছোকরা অমরের সকালে আসবার কথা, কিন্তু এত ভোরে তো নয়! তাহলে প্রিন্টার সুরেনবাবু কি আমাকে ধরবার জন্যে গ্যাঁট হয়ে আমার ঘরেই বসে আছেন?
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন আর পরিশ্রান্ত দেহ আমার ক্লান্ত পা দুটোর উপর ভর করে লম্বা করিডর পার হল। এবার আমার ঘরের সামনে এসে হাজির। একটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে দরজায় পা দিতেই আমি চমকে উঠলাম। এ কী, এ কাকে দেখছি! এ যে আমার কল্পনার অতীত! সুবোধবাবু আমার পাশের টেবিলটায় বসে একাগ্রচিত্তে খখস করে লিখে চলেছেন, ঘরের এক কোণায় অমর চুপচাপ বসে।
গভীর আবেগে আমার সমস্ত দেহমন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, একটা পুলক শিহরণ বিদ্যুতের মত আমার শরীরের ভিতর দিয়ে খেলে গেল। সুবোধবাবুর দিকে আমি তাকিয়ে আছি, সুবোধবাবুও একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। স্নিগ্ধ মধুর প্রসন্ন হাসিতে সে-মুখ ভোরের আলোর মতই উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আবার তিনি লেখায় ডুবে গেলেন। কোন বাক্য বিনিময় নয়, সেই প্রশান্ত হাসিতেই জানিয়ে দিলেন—আর ভাবনা নেই, লেখা আপনি পাবেনই।
বিগত রাত্রির যত গ্লানি আর ব্যর্থতা আমার অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল এক মুহূর্তে, বিপুল আনন্দের আবেগ আমার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারায় নেমে এল। আনন্দা কথাটার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, তাকে অন্তর দিয়ে অনুভব এর আগে কখনও করি নি।
এই আবেগোচ্ছাস আমি দমন করতে পারি নি। ঘরে ঢুকেই সুবোধবাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি, আমার দুই চোখে জলধারা।
এ কি, আপনি যদি এরকম সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েন তাহলে আমার অবস্থাটা ভাবুন, আমি লিখব কি করে? একটা আবেগবুদ্ধ চাপা গলায় সুবোধবাবু বললেন।
পুব দিকের খোলা জানালা দিয়ে শরতের নির্মেঘ নীলাকাশে চোখ পড়ল, সোনার আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত।
অমরকে দুটো টাকা দিয়ে বললাম-যা, দৌড়ে গিয়ে গরম গরম সিঙ্গাড়া কচুরি আর মিষ্টি কিনে আন, সেই সঙ্গে চা-ও বলে আসবি।
অমর প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল, যাবার সময় সুবোধবাবুর কাছ থেকে ১৫ নম্বর পিটাও নিয়ে গেল প্রেস-এ দেবার জন্যে।
অমর চলে যেতেই সুবোধবাবু বললেন–রাত সাড়ে চারটার সময় জামা-কাপড় পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে বসে কিছুই যখন লিখতে পারলাম না, তখন অফিসে গিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করা যাক। গোলপার্কে এসে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। অফিসে এসে আপনার ঘরে দেখি টেবিলে পত্রিকার ফাইল মাথায় দিয়ে অমর শুয়ে আছে।
আমি বললাম-অমরকে সকাল সাতটায় আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ও শুনে গিয়েছিল যে রাত দুটোর সময় আপনার বাড়ি থেকে লেখা নিয়ে প্রেস-এ দেব। পাছে আমার কোন অসুবিধা হয় সেই জন্যেই বোধ হয় বাড়ি গিয়ে এ-ঘরেই শুয়েছিল।
সুবোধবাবু আবার লেখায় ধ্যানস্থ হলেন। একটা করে স্লিপ লেখা হয়, অমর সেটা তৎক্ষণাৎ প্রেস-এ দিয়ে আসে। প্রিন্টার সুরেনবাবুর অবস্থা যেন একটা ভূতে পাওয়া মানুষ। পাচ হাতে কম্পোজ ধরিয়ে প্রেসময় ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন। দেখতে দেখতে বেলা দশটা বাজল, অফিসে শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘনঘন গৌরাঙ্গ প্রেস থেকে টেলিফোন আসছে। প্রভাতবাবুর ওই এক কথা—দুটোর মধ্যেই ফর্মা কিন্তু চাই।
ওদিকে ঝড়ের মত হইহই করতে করতে ঘরে ঢুকলেন সাকুলেশন ম্যানেজার ভূপেনদা।
এই যে সাগরময়বাবু, তুমি তো দেখছি ভাই ডুবিয়ে দিলে। এখনও ফর্মা ছাড় নি, দপ্তরীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। লেট যদি হয় কাগজ এক কপিও বিক্রি হবে না।
বেলা যতই বাড়ছে ঘরে জনসমাগমও বেড়ে চলেছে। কেউ সহানুভূতি, কেউ বিস্ময়, কেউ আশঙ্কা জানাচ্ছেন, তারি মধ্যে কাজও চলেছে পুরোদমে। সুবোধবাবু লিখেই চলেছেন। পর্বতের মত ধীর স্থির অচঞ্চল, কলম চলেছে বিদ্যুৎগতিতে।
বেলা বারোটার সময় গল্পের শেষ স্লিপটা প্রেস-এ দিয়ে যখন অমর ফিয়ে এল তখন আর তার দাঁড়াবার শক্তি নেই। বেচারি নব্বইবার সিঁড়ি ভেঙ্গে প্রেস-এ গিয়েছে আর এসেছে। সুবোধবাবু সেবার নব্বই স্লিপ লিখেছিলেন।
থির বিজুরী গল্প লেখার ইতিহাস হচ্ছে এই। যে সময়ের মধ্যে, যে মানসিক অবস্থায় এবং পরিবেশে এ গল্প লেখা হয়েছিল তাকে আমি সুবোধবাবুরু পক্ষে অলৌকিক কীর্তি ছাড়া আর কী বলতে পারি।