আমি নিরুত্তর। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। কত আশা ভরসা উৎসাহ নিয়ে এসেছিলাম, ফুংকারে তা নিবে গেল।
ট্যাক্সির শিখ ড্রাইভার অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, ছাড়া পাবার জন্য ব্যস্ত। সুবোধবাবুর কথার কোন জবাব না দিয়ে আমি ড্রাইভারের ভাড়া চুকিয়ে দিলাম। ট্যাক্সি ধরে রেখে আর কী লাভ। ততক্ষণে মনে মনে একটা সংকল্প করে ফেলেছি। কাছেই তো লেক। ঘণ্টা দুই সময় লেকের ধারে কাটিয়ে দিয়ে শেষ রাত্রের প্রথম ট্রাম ধরে অফিসে ফিরে যাব। আগের যা কম্পোজ ম্যাটার দু-একটা আছে তাই দিয়ে পাতা ভরাট করে সকাল বেলায় ফর্মা গৌরাঙ্গ প্রেস-এ পাঠিয়ে দিয়ে এ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেব। সুবোধবাবুর মুখের দিকে তাকালাম। লজ্জায় ও বেদনায় ওঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কথা না রাখতে পারার যন্ত্রণায় যে ওঁর মন কতখানি ক্লিষ্ট তা বুঝবার অবকাশ পাই নি। পরাজয়ের গ্লানিতে আমার মন আচ্ছ, ওঁর দিকটা ভেবে দেখবার মত বিচারবোধ তখন আমি হারিয়েছি।
লেখা যখন পেলামই না এবং পাবার আর কোন সম্ভাবনাও যখন নেই তখন এই মাঝরাতে সুবোধবাবুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখার কোন অর্থ হয় না। এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে এঁকে রেহাই দেবার জন্য বললাম-আপনি যান সুবোধবাবু, অসময়ে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে অপরাধ করেছি, কিছু মনে করবেন না।
আমার বলার ধরনটায় বোধ হয় একটু প্রচ্ছন্ন অভিমান ছিল। সুবোধবাবু বেদনাহত কণ্ঠে বললেন–আমাকে ভুল বুঝবেন না সাগরবাবু। আপনাকে লেখা দিতে না পারার যন্ত্রণা আমার কিছু কম নয়। কিন্তু কী যে হল, কিছুই ভাবতে পারছি না, লিখতে পারছি না। কতবার লিখবার সংকল্প নিয়ে বসেছি, এক লাইনও লিখতে পারি নি। আবার অনুরোধ করছি, আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না।
এরপরে আর কী বলা যায়। সুবোধবাবুর অসহায় অবস্থাটা এতক্ষণে হৃদয়ঙ্গম করলাম। আমরা দুজনে আবার ওকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি, এবার সুশীলবাবুর কাছ থেকে আমার বিদায় নেবার পালা। কিন্তু এই গভীর রাত্রে আমাকে একলা কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না। জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়িতে। বসবার ঘরে আমার জন্য বিছানার বন্দোবস্ত করে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন, যাবার সময় শুধু বলে গেলেন–
সকালে না জানিয়ে এবং চা না খেয়ে কিন্তু চলে যাবেন না।
রাত তখন তিনটা। চোখে ঘুম নেই। গত একমাস ধরে শারদীয়া সংখ্যার জন্য যে চিন্তা ভাবনা পরিশ্রম করে এসেছি, শেষ দিনের এই নিষ্ফল হতাশা সব ব্যর্থ করে দিয়েছে। মনের মধ্যে ধিক্কার দেখা দিল। ছি ছি ছি—শেষকালে সামনের দিকের ওই আটটা পৃষ্ঠা কিনা কতকগুলো বাজে ম্যাটার দিয়ে ভরাতে হবে? ওদিকে প্রিন্টার আমার অনুরোধে পাঁচটা কম্পোজিটরকে বসিয়ে রেখেছেন। আশা করে আছেন এই মুহূর্তেই আমি লেখা নিয়ে হাজির হব। ওদের কাছেই বা সকালে মুখ দেখাব কী করে? আর গৌরাঙ্গ প্রেসের প্রভাতবাবু? টেলিফোনে গলা ফাটিয়ে বলবেন—
সুবোধবাবুর গল্পই যদি আদায় করতে না পারলেন তাহলে ফর নাথিং ফর্মা আটকে রাখলেন কেন? অর্থাৎ আমি যে এতবড় একটি পত্রিকার সম্পাদনা কার্যের দায়িত্ব গ্রহণে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত এদের সবার কাছে তা আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যাবে।
ঘরের দেওয়াল-ঘড়িটায় & ঢং করে চারটে বাজল, যেন চার বার হাতুড়ির ঘা পড়ল আমার মাথায়। এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে, ব্যর্থতার জ্বালায় আমার চোখ জ্বলছে! ঘুম আসবে কেন?
আরেকজন? যাকে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে রাস্তায় টেনে এনে আবার বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছি তিনিও আমারই মতন আর এক যন্ত্রণায় ঘরময় শুধু পায়চারি করছেন আর ঘুমাতে পারেন নি। ঘরে ফিরেই গৃহিণীকে দিয়ে খবরের কাগজ পুড়িয়ে চা তৈরী করিয়ে ছিলেন, চা খেয়ে যদি লেখায় মন বসে। এ কথা আমি পরদিন শুনেছিলাম সুবোধবাবুর কাছেই।
দেয়াল ঘড়িটা আবার ঢং করে বেজে উঠল। সাড়ে চারটা বেজেছে। এবার আমাকে যেতে হবে। ট্যাক্সি যদি না পাই তবে শেষ রাতের প্রথম ট্রামটা ধরেই রওনা দিতে হবে অফিসের পথে। দুঃখের রাত্রির অবসানই আমি তখন চাইছিলাম।
সুশীলবাবুর বাড়ির বুড়ি ঝি সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে উঠোনে উনুন ধরাবার তোড়জোড় করছে দেখতে পেয়ে নিঃশব্দে কাউকে কিছু না জানিয়ে বৈঠকখানা ঘরের দরজা খুলে রাস্তায় নেমে পড়লাম।
গড়িয়াহাট বাজারের সামনে এসে এসপ্ল্যানেডগামী প্রথম ট্রামটাই পেয়ে গেলাম। গঙ্গাস্নানার্থী বৃদ্ধের দল সমস্বরে এবং তারস্বরে চৌতালে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে চলেছেন। এটা তাদের নিত্যকর্ম।
এসপ্ল্যানেড থেকে ট্রাম বদলি করে যখন বর্মণ স্ট্রীটে এসে পড়েছি তখন সোয়া পাঁচটা বেজেছে। ভোরের আলোয় সবেমাত্র মহানগরী জেগে উঠেছে, রাত্রি জাগরণ-ক্লান্ত শরীরটা কোন রকমে বয়ে নিয়ে এসেছি। চোখে-মুখে জল পর্যন্ত দেওয়া হয় নি, চুল অবিন্যস্ত, জামাকাপড়ের দিকে তাকানো যায় না। গতকাল সকালে মন্মথবাবুকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসের গেট এর সামনে ঠিক এই অবস্থাতেই দেখেছিলাম। কিন্তু তার অন্তর ছিল সকল সার্থক শ্রমের আত্মতৃপ্তিতে ভরা। আর আমার? গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ-হাতে প্রেস। না। প্রেস-এ নয়, প্রেস-এ এখন যাব না। রাত দুটো থেকে প্রিন্টার বোধ হয় পাগলের মত আমার খোঁজ করেছেন। এখন দেখা করলেই ভুরু আর গোঁফের দ্বৈত তাণ্ডবনৃত্য শুরু হয়ে যাবে। তার চেয়ে মেক-আপ ম্যানকে ডেকে পাঠিয়ে যা করণীয় তাকেই বুঝিয়ে দেব। একতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে একটা সাঁকো পার হতে হয়। সেই সাঁকো পার হবার সময় পূর্ব প্রান্তে আমার ঘরের দরজাটা দেখা যায়। বরাবরের অভ্যাস মত সেদিকে চোখ ফেরাতেই চমকে উঠলাম। আমার ঘরের দরজা খোলা। কেন?