যাক, মোক্ষম দুটো ঘটি তো ম্যানেজ করা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তার ভারও নেমে গেল অনেকখানি। কিন্তু আসল সমস্যা থেকে গেল সুবোধবাবুর লেখা এবং তা রাত দুটোর মধ্যে প্রেস-এ কম্পোজের জন্য ধরিয়ে দেওয়া।
রাত তখন নটা। সাহিত্যিক বন্ধুরা একে একে প্রায় সবাই বিদায় নিয়েছেন, শুধু ধরে রেখেছি কবি ও কথাসাহিত্যিক বন্ধু সুশীল রায়কে। ওদিকে রজগতের সমালোচক শৌভিক আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। ভারতী সিনেমায় সংগীত সম্মেলনে একসঙ্গে যাবার কথা। আপৎকালে সুশীলবাবুর পরামর্শ আমার কাছে সর্বদাই এহ। সে সময়ে সুবোধবাবু থাকতেন কাকুলিয়া রোডের দক্ষিণপ্রান্তে, সুশীলবাবুর বাড়ির কাছেই। সুশীলবাবুই প্রস্তাব করলেন যে, এখন বেরিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবী দোকান থেকে রুটি মাংস খেয়ে সংগীত সম্মিলনীতে বসা যাক। রাত দুটো পর্যন্ত ওখানে সময় কাটিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সুবোধবাবুর বাড়ি গেলেই হবে। ততক্ষণে নিশ্চয় অনেকখানি লেখা এগিয়ে থাকবে।
সুশীলবাবুর প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সুবোধবাবুর কথা অনুসারে যদি রাত দশটা থেকেও লেখা শুরু করে থাকেন তাহলে রাত দুটোর মধ্যে অন্তত অর্ধেক লেখা তৈরী থাকবে, সে-লেখা নিয়ে ওই ট্যাক্সিতেই প্রেস-এ চলে এলেই হবে। বাকীটা আবার ভোর বেলা গিয়ে নিয়ে এলেই হল। সমস্যার কত সহজ সমাধান।
অফিস থেকে বেরিয়ে ভবানীপুরের এক পাঞ্জাবীর দোকানে বসে তিনজনে তড়কা মাংস আর রুটি খেয়ে ভারতী সিনেমায় গিয়ে গাট হয়ে বসলাম, তখন রাত দশটা হবে। কার যেন একটা কথক নাচ হয়ে যাবার পর ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ আসরে এসে বসলেন। এমদাদ খাঁ-এনায়ৎ খর ঘরানার বিখ্যাত খাম্বাজ ধরলেন সেতারে। মন্ত্রমুগ্ধের মত বাজনা শুনছি, সুরের মায়াজাল বিস্তার করে আলাপের পর গৎ বাজিয়ে যখন শেষ করলেন তখন রাত দেড়টা। জনাকীর্ণ প্রেক্ষাগৃহ সমস্বরে আবেদন জানাল ঠুংরি, ঠুংরি। মৃদু হেসে আবার সেতারটি কোলের উপর তুলে নিলেন ওস্তাদ বিলায়েৎ খা। সবাইকে চমকে দিয়ে সুর ধরলেন রবীন্দ্রনাথের গানের-ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। গানের প্রথম ছত্রের সুরটি নিয়ে কত রকমের কাজ, কত বিচিত্র নক্শা তুলে বিস্ময়ের পর বিস্ময় সৃষ্টি করে চললেন যাদুকরের মত।
খাঁ সাহেবের বাজনার সুর ও ছন্দে যখন সবকিছু ভুলে যেতে বসেছি, সুশীল রায় কানের কাছে মুখ এনে বললেন—দুটো বাজতে আর দশ মিনিট বাকি, এবার উঠতে হয়।
চমকে উঠেছি। তাই তো! সেতারের তান-কর্তবের সঙ্গে তখন কেরামউল্লার তবলার কেরামতি চলেছে, উত্তর প্রত্যুত্তর। তবু উঠে আসতে হল। সুশীলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এসেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। গোল পার্ক পার হয়ে ঢাকুরিয়া লেভেল ক্রসিং-এর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসেই বাঁদিকের রাস্তাটা শেষ হয়েছে কাকুলিয়া রোডের উপর পড়েই। ট্যাক্সিটা ওখানে দাড় করিয়ে রেখে দুজনে ডানদিকে এগিয়ে গেলাম। নিস্তব্ধ নিঝুম পাড়া, অস্পষ্ট চাদের আলো গাছ পালার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এলে, পড়েছে।
সুবোধবাবু থাকতেন একটা দোতলা বাড়ির উপর তলায়। পুব দিকের ঘরটা রাস্তা থেকেই দেখা যায়, সেই ঘরে বসেই লেখাপড়া করেন। পুব দিকের জানালা ছুঁয়ে একটা পেয়ারা গাছ, গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ালেই কচি পাতার স্পর্শ পাওয়া যায়।
ট্যাক্সি থেকে নেমেই কল্পনায় একটা মধুর ছবি ফুটে উঠল। চারদিকে গভীর রাত্রির স্তব্ধতা, সুবোধবাবু লিখবার টেবিলে শান্ত সমাহিত চিত্তে লিখে চলেছেন। পুব জানালা দিয়ে ইলেকটিকের আলোটা এসে পড়েছে পেয়ারা গাছটার কচি পাতার উপর।
সুবোধবাবুর বাড়ির সামনের সরু গলিটার ভিতর মোড় নিয়েই দোতলা বাড়িটার পুব দিকের খোলা জানালাটার দিকে তাকালাম। অন্ধকার জানালা। সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির সব অন্ধকার যেন আমার উপর পাথরের মত জমাট বাঁধতে লাগল। বিশ্রী একটা আশঙ্কায় আমার সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে এসেছে। সুশীলবাবুর দিকে তাকালাম, তাঁর চোখে-মুখেও সন্দেহের ছায়া। সন্দেহ আর কিছুই নয়, সুবোধবাবু কি তাহলে কিছুই লেখেন নি?
একতলায় সিঁড়ির দরজার কড়াটা খটখট করে কয়েকবার নাড়লাম, উপর থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই। অবশেষে মরিয়া হয়ে ডাক ছাড়লাম–
সু বো ধ বা বু—
নাম ধরে ডাক নয়, যেন বুক ঠেলে একটা হাহাকার রুদ্ধশ্বাস কষ্ট ঠেলে বেরিয়ে এল। পাড়ার লোক মনে করল হয়তো কোন সদ্যমৃত আত্মীয় বন্ধুর সংবাদ নিয়ে কেউ ডাকাডাকি করছে।
বার তিন চার ডাকাডাকির পর হঠাৎ দোতলার ভিতর থেকে আলোর রেখা দেখা দিল পেয়ারা গাছটার কচি পাতার উপর। পরমুহূর্তেই দোতলার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে-আসা চটিজুতোর আওয়াজ পাওয়া গেল। একতলার সিঁড়ির দরজাটা খুলেই সুবোধবাবু আমাদের দুজনকে দেখে চমকে উঠলেন, যেন ভূত দেখছেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। সুবোধবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
রাত দুটোর সময় এমন অতর্কিতে ওঁর বাড়িতে হানা দিতে পারি এটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। উভয়ের মুখে কোন কথা নেই, সুশীলবাবুও স্তব্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে।
সুবোধবাবুই মুখ খুললেন। বললেন—রাস্তার মোড়ে চলুন সব বলছি।
মোড়ে ট্যাক্সিটাকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম সেখানে তিনজন নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালাম। সুবোধবাবু বেদনাভরা চাপা গলায় বললেন–এবার আমাকে ক্ষমা করুন। আমি পারব না, পারলাম না।