বিকেল পাঁচটার সময় আমার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। সুবোধ বাবুর টেলিফোন। বললেন—একবার উপরে আসতে পারবেন?
টেলিফোন রেখেই তিন তলায় ছুটলাম। তা হলে গল্প লেখা শুরু হয়ে গেছে, প্রেস-এ কপি দেবার জন্যই ডাকছেন। ঘরে ঢুকে দেখি সুবোধবাবুর মুখ গম্ভীর, থমথমে, চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। বুঝলাম আমার অনুমান সম্পূর্ণ মিথ্যে।
সুবোধবাবু কাতর কণ্ঠে বললেন–কি করি বলুন তো?
–কেন, কী হল?
–আমাদের এখানে আজ অমলেন্দুবাবুর অফ ডে, ব্ৰজেনবাবু অসুস্থতার জন্য আসতে পারেন নি। চপলাবাবুর আজ আবার কোথায় সভা আছে, সেখানে গেছেন আমার উপর প্রথম সম্পাদকীয় লেখার ভার দিয়ে। কোনও রকমে সেটা এইমাত্র শেষ করেছি, কিন্তু মাথা অত্যন্ত ভার হয়ে আছে, যন্ত্রণাও হচ্ছে। আপনার গল্প শুরু করব বলে এতক্ষণ ভাবছিলাম, কিন্তু মাথার এমন অবস্থা যে কিছুই ভাবতে পারছি না। আপনিই একটা উপায় বলে দিন।
একথা শোনার পর নিজেই যখন অগাধ জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি তখন আরেকজন হাবুডুবু খাওয়া লোককে উদ্ধার করি কী প্রকারে। কিন্তু সুবোধ বাবুর চেহারার ওই অবস্থা দেখে ওর উপর জোরজবরদস্তি করতে নিজেরই মায়া হল।
আমার সমস্যা হল সুবোধবাবুর গল্প আজই যদি কম্পোজ করতে না দিতে পারি তাহলে গল্পই বাদ যায়। তার পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থাই বা শেষ মুহুর্তে করি কি ভাবে। সামনের দিকের ফর্মা, সেখানে একজন অখ্যাত লেখকের লেখা দেওয়াটা দৃষ্টিকটু। তাছাড়া বিজ্ঞাপনে আমরা ঘোষণা করেছি সুবোধ বাবুর গল্প শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। বিজ্ঞাপিত লেখা না দিতে পারাটা সম্পাদনা কাজের অমার্জনীয় অপরাধ। পাঠকরা লেখককে ক্ষমা করতে পারেন, সম্পাদককে করবেন না। সে-সময়ে সুবোধবাবু বেশী লেখা। লিখতেন না। শারদীয়া সংখ্যায় দুটি মাত্র গল্প লিখতেন। একটি আনন্দবাজারে, অপরটি দেশ পত্রিকায়। সুতরাং দেশ পত্রিকায় এবারে সুবোধবাবুর গল্প থাকবে না—এটা আমার কাছে শুধু বেদনাদায়ক নয়, অকল্পনীয়ও বটে। আমার অবস্থাটা সুবোধবাবুর কাছে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলার পর সুবোধবাবু বললেন–তা হলে এক কাজ করি। আমি এখনই বাড়ি চলে যাই। মাথার যে-রকম অবস্থা, এখানে বসে শত চেষ্টা করলেও এক লাইন লেখা হবে না। বাড়ি গিয়ে, স্নানটান করে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর লিখতে বসব। নির্জন রাত্রে লেখাও হবে ভালই। কী বলেন?
কী আর বলব। সুবোধবাবুর প্রস্তাবে রাজি না হয়ে আমার আর উপায় কি। কিন্তু একটা প্রশ্ন দেখা দিল। বাড়িতে বসে রাত্রে যদি লেখেনও সেলেখা কম্পোজ হবে কখন? সুবোধবাবুকে আর আটকে রাখলাম না, বাড়ি চলে গেলেন। দুশ্চিন্তার বোঝা নিয়ে নিজের ঘরে এসে বসেছি, যথারীতি দু-চারজন সাহিত্যিক বন্ধুর সমাগম হয়েছে। কোন কাজে মন বসছে না, আর বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে দু-দণ্ড রসালাপ করব সে মেজাজও আর নেই। আমার মাথায় তখন এক চিন্তা সুবোধবাবু যদি রাত্রে বাড়িতে বসে লেখেনও, সে-লেখা কম্পোজ হবে কখন?
এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন আরেকজন, তিনি আমাদের প্রিন্টার সুরেনবাবু। এই প্রিন্টারই একদিন সুবোধবাবুর হাতের লেখা কপি এনে আমাকে বলেছিলেন—এই লেখককে বলবেন স্পষ্টাক্ষরে ধরে ধরে লিখতে, কোন কম্পোজিটারই এই লেখা কম্পোজ করতে চায় না। খর্বকায়, শীর্ণদেহ, বয়স ষাট-এর কাছাকাছি। আশুতোষ মুখার্জি প্যাটার্নের একজোড়া পাকা গোঁফ ও পাকা ভুরু হচ্ছে ওঁর চেহারার প্রধান আকর্ষণ। পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় এত দ্রুত কথা বলেন যে, এক বর্ণও বোঝা যায় না। কথা বলার সময় গোঁফ আর ভুরু সমানতালে নাচতে থাকে। এই ভুরু ও গোঁফ-নৃত্যের মুদ্রা যদি আমার জানা থাকত তাহলে কাজটা অনেক সহজ হত। আমি অবশ্য সেই চেষ্টাই করতাম। কথা বলার সময় সুরেনবাবুর গোঁফ ও ভুরুর নাচন দেখে খানিকটা অনুমান করবার চেষ্টা করতাম ওঁর বক্তব্য বিষয়টি কী।
এখন সুরেনবাবুর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই জেনে কাজকর্ম চাপা দিয়ে চলে গেলাম প্রেস্-এ। সুরেনবাবুকে মুশকিলের কথাটা সবিস্তারে বলার পর আসানের ফিকির শুনবার জন্যে সতৃষ্ণ নয়নে ওঁর গোঁফ ও ভুরু জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছি। লক্ষ্য করলাম, খুবই দ্রুত গোঁফ ও ভুরু নেচে উঠল, আর সেই সঙ্গে মুখ থেকে ততোধিক দ্রুত একটি শব্দ বেরিয়ে এল :-
ক্যাচ্ছিরিয়স্।
বিচ্ছিরি একটা উচ্চারণ শুনে প্রথমে আমি হকচকিয়ে গেলাম। সন্ধিবিচ্ছেদ করতেই অর্থ উদ্ধার হল-কেস সিরিয়। সুবোধবাবুর গল্পের কপি মধ্যরাত্রে পেলেও উপায় নেই, ভোর ছটার মধ্যে ফর্মা তৈরী করা অসম্ভব। সুতরাং বিষয়টা খুবই সিরিয়। দ্বিতীয়ত, শারদীয়া সংখ্যায় সুবোধবাবুর গল্প থাকবে না—সেটাও কম সিরিয় ব্যাপার নয়।
মিনিট কুড়ি যাবং অনেক গোঁফ আর ভুরু নাচানাচির পর সুরেনবাবু আমাকে আশ্বাস দিয়ে জানালেন যে ঘাবড়াবার কিছু নেই। রাত্রি আড্ডাইটার পর দৈনিকের কাজ শেষ হলেই পাঁচটা মেশিনে পাঁচ হাতে কম্পোজ ধরিয়ে দেবেন, সেই অনুসারে কম্পোজিটরদের বলে কয়ে আটকে রাখবেন। যেকরেই হোক আমাকে শুধু রাত আড্ডাইটার মধ্যে বেশ কিছু কপি এনে হাজির করতে হবে। আর ওদিকে গৌরাঙ্গ প্রেসকে বলে রাখতে হবে ভোর ছটায় ফর্মা যাবে না, বেলা ১টার আগে ফর্মা পাঠানো সম্ভব নয়।
সুবোধবাবুর গল্প পূজা-সখ্যা থেকে বাদ যাবে-এটা যেন কম্পোজিটরপ্রিন্টার থেকে শুরু করে গৌরাঙ্গ প্রেসের ম্যানেজার পর্যন্ত কারোরই মনঃপুত নয়। গৌরাঙ্গ প্রেস-এর ম্যানেজার যে-প্রভাতবাবু এতক্ষণ ফর্মা চাই, ফর্মা চাই বলে তারস্বরে চিৎকার করে গলা ভেঙ্গে বসে আছেন সেই প্রভাতবাবুও সহসা সব বৃতান্ত শুনে সুর পালটে ফেললেন। বললেন–কুছ পরোয়া নেই। বেলা একটা কেন, বেলা দুটোর মধ্যেও যদি আপনি ফর্মা পাঠাতে পারেন আমি দিনরাত মেশিন চালিয়ে ঠিক সময়ে কাগজ বার করে দেব।