মন্মথবাবু বললেন–সুবোধবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করছেন তো? আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় লেখা শেষ করে সন্ধ্যের পর পূজার গল্পে হাত দেবেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম-সে কী, এখনও গল্পে হাত দেন নি? তা হলে তো আজ সারারাত আপনার দুর্ভোগ আছে।
মন্মথবাবু হেসে বললেন–কোন্ বছরই বা না থাকে। কাল ভোর ছটার মধ্যে ফর্মা পাঠাতে হলে সারারাত সুবোধবাবুর সঙ্গে জেগে কাটাতে হবেই।
আমি বললাম-আপনারই যখন এই অবস্থা তখন আমার কী হবে বলুন তো?
মন্মথবাবু হেসে বললেন–আমি একাই শুধু রাত জাগব আপনি জাগবেন, তা কি হতে পারে?
আমিও মনে মনে ভাবলাম কথাটা ঠিক। শেষ দিনের অহোরাত্র জাগরণ দুজনের ভাগ্যে লেখা যখন আছে-খণ্ডন করবে কে? সেদিনের মত পূজা সংখ্যার কাজ চুকিয়ে রাত নটার সময় উঠে পড়লাম।
বাড়ি ফেরার পথে একবার ভারতী সিনেমায় ঘণ্টা তিনেক কাটাতে হবে। তানসেন সংগীত সম্মেলন চলেছে, বড় বড় ওস্তাদদের গানবাজনার আসর। সংগীত সম্মেলনের মরসুমে এ-ধরনের আসরে প্রতিরাত্রে একবার টু মারা আমার বরাবরের অভ্যাস।
অফিস থেকে বেরোবার সময় তিন তলায় মন্মথবাবুর ঘরে উঁকি মেরে দেখি সুবোধবাবু বসে আছেন, টেবিলের উপর সাদা প্যাড, তাতে একটিও কালির আঁচড় পড়ে নি। কলমটা ভোলা অবস্থাতেই পাশে শোয়ানো। একটা সিগারেট ধরিয়ে রাত্রির আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে চুপচাপ বসে। ঠোঁটের কোণায় ধরে রাখা সিগারেটটা আপনিই পুড়ে চলেছে। পাশের টেবিলে মন্মথবাবু ও তার সহকারী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একমনে কি একটা লেখার পেজ প্রুফ দেখছেন। ঘরের এক কোণে কয়েকটা মাটির ভাড় আর শালপাতা দেখেই অনুমান করলাম আমজাদিয়া হোটেল থেকে মাংসর চাপ আর রুটি এসেছিল, তিনজনেরই রাত্রের আহার সমাধা হয়েছে। আমার তাগাদা নিয়ে এই সময় সুবোধবাবুর কাছে উপস্থিত হওয়াটা সমীচীন বোধ করলাম না। নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
পরদিন একটু তাড়াতাড়িই অফিসে হাজির হয়েছি। বেলা প্রায় দশটা হবে। অফিসে ঢুকেই দেখি গেট-এর কাছে মন্মথবাবু দাঁড়িয়ে। উভ্রান্ত চেহারা। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মুখে চোখে থমথমে গাম্ভীর্য। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রিকশায় ফর্মা ভোলাচ্ছেন গোরাঙ্গ প্রেস-এ পাঠাবার জন্য।
আমাকে দেখেই মন্মথবাবু যত রাগ আর বিরক্তি এতক্ষণ পুষে রেখেছিলেন তা প্রকাশ করে ফেললেন।
দেখুন মশাই, এই গৌরাঙ্গ প্রেস সকাল থেকে টেলিফোন করে করে আমাকে পাগল করে তুলেছে।
আমি সহানুভূতি দেখিয়ে বললাম—ওদের তো ওই এক কথা, ফর্মা চাই এবং এক্ষুনি চাই।
মনে মনে আমিও প্রমাদ গণলাম। কাল সকালে ঠিক সময়ে ফর্মা না। পাঠাতে পারলে আমাকেও তো একই অবস্থায় পড়তে হবে। রাত্রি জাগরণ, মানসিক উদ্বেগ, সব মিলিয়ে মন্মথবাবুর চেহারা দেখে আগামীকাল সকালের আমার অবস্থাটা কল্পনা করে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। রিকশা করে ফর্মা রওনা করে দিয়ে মন্মথবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মুক্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন–
যাক, কন্যাদায় এ বছরের মত চুকল। এবার গঙ্গাস্নান করে বাড়ি যাওয়া যাক।
কাতরকণ্ঠে আমি বললাম-আপনি তো ভালয় ভালয় চুকিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার কি উপায় হবে বলুন তো?
মন্মথবাবু এখন মুক্তপুরুষ, তাই আমার প্রতি প্রচুর সহানুভূতি আর সান্ত্বনা ঢেলে বললেন—ও কিছু ভাববেন না। সুবোধবাবু ভোর ছটায় ওঁর গল্পের ফাইন্যাল প্রুফ দেখে দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। ঘণ্টা তিন চার ঘুমিয়ে চান-খাওয়া করেই আবার অফিসে আসবেন। আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় কিছু লিখবার যদি থাকে তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চুকিয়ে দিয়েই আপনার গল্প লিখতে বসবেন একথা বলে গেছেন।
চব্বিশ ঘণ্টা আগে মন্মথবাবুর মানসিক উদ্বেগের অবস্থাটা আমার জানা আছে। সুতরাং ওঁর অভয়বাণীতে খুব বেশী ভরসা করতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়েই নিজের ঘরে গিয়ে বসলাম। পূজা সংখ্যার আর যা-কিছু টুকিটাকি কাজ তা চুকিয়ে রেখে শুধু সুবোধবাবুর প্রত্যাশিত গল্পের আট পৃষ্ঠার গোড়ার দিকের ফর্মাটা জগদ্দল পাথরের মত গলায় ঝুলে রইল।
বেলা একটার সময় সুবোধবাবু অফিসে এসে হাজির। তিনতলায় নিজের ঘরে যাবার আগে দোতলার পূর্ব প্রান্তে আমার ঘরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলেন। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ, সকালে কিছুক্ষণ যে ঘুমোতে পেরেছেন, মনে হল না।
আমি বললাম—অপিনার চেহারা বড়ই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কাল সারারাত পরিশ্রম করেছেন, সকালে ঘুম হয় নি বোধ হয়?
সুবোধবাবু বললেন—কি করে হবে। আনন্দবাজারের গল্পটা যে ভাবে ফেঁদে ছিলাম, লিখতে লিখতে বড় হয়ে গেল। ওদিকে হেডপী আর কিছু বিজ্ঞাপন আছে, আটপাতায় ধরে না। শেষকালে অনেক বাদছাদ দিয়ে ধরাতে হল। তাই মনে একটা খুত থেকে গেছে, সেই চিন্তাতেই ঘুম আর হয় নি।
চোরের মন যেমন বোঁচকার দিকে থাকে, আমার চিন্তা কেবল দেশ পত্রিকার গল্পের জন্য। আমি বললাম-দেশের গল্পটা আজ বিকেলেই লিখতে শুরু করবেন তো? আমি প্রিন্টারকে বলে কম্পোজের সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি, এখন কপি দিলেই হয়।
সুবোধবাবু বললেন–যাই, তেতালায় গিয়ে দেখি দৈনিকের জন্য আমার কি লেখা আছে। যদি যৎকিঞ্চিৎ লিখতে দেয় তাহলে বেঁচে যাই। তাড়াতাড়ি শেষ করেই আপনার লেখায় হাত দেব।
এক কাপ চা আর সিগারেট খেয়েই সুবোধবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন—আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম যে আজ বিকেল থেকেই প্রেস-এ কপি ধরাতে পারব। রাত বারোটা একটার মধ্যেও যদি সুবোধবাবু লেখা শেষ করে দেন তাহলে কাল ভোর ছটার মধ্যে গৌরাঙ্গ প্রেস-এ ফর্মা পাঠাতে বেগ পেতে হবে না।