সারাদিনের ধকলের পর আমাদের সকলেরই মেজাজ প্রায় সপ্তমে চড়ে থাকে। তার উপর গৌরাঙ্গ প্রেসের এই ভয় আর আতঙ্ক মিশ্রিত গেল গেল রব শুনলে কার না খারাপ লাগে। অগত্যা প্রভাতবাবু যে পর্দায় গলা চড়িয়ে চিৎকার করছেন প্রায় তার কাছাকাছি আমার গলাটা চড়িয়ে বললাম–
আমাকেই বারবার ফর্মার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন কেন? আগে তো আপনারা মেল ট্রেনকেই পাস করবেন, তার পরে তো এক্সপ্রেস। আনন্দ বাজারের কি সব দেওয়া হয়ে গিয়েছে?
সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতবাবুর সুর নেমে গেল। বললেন–
জানেন তো সব। সুবোধবাবুর গল্প এখনও লেখা হয় নি। আজ রাত্রে বসে গল্প লিখবেন, সারারাত কম্পোজ হবে, মেক-আপ হবে, কাল ভোরে ফর্মা পাঠাবেন। ইতিমধ্যে আপনার একটা ফর্মা পেয়ে গেলে কাজ এগিয়ে রাখতে পারতাম।
আমি কি আর জানি না? হাড়ে হাড়ে জানি, মজ্জায় মজ্জায় জানি। আজকের মতন পূজা সংখ্যা বা সাপ্তাহিক সংখ্যা সেদিন রোটারি মেশিনে ছাপা হত না। আট পৃষ্ঠার ফর্ম কম্পোজ ও মেক-আপ করে গৌরাঙ্গ প্রেস-এ পাঠাতে হত, তাঁরা ফ্ল্যাটবেড মেশিনে তা ছেপে দিতেন। একালের মত একসঙ্গে বত্রিশ পাতা রোটারি মেশিনে ছাপা হত না বলে ঠিক সময় মত লেখা, কম্পোজ, ইলাস্টেশন ব্লক ও বিজ্ঞাপনের যোগান না পেলে কাজ যেত বানচাল হয়ে এবং প্রেসের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া লেগেই থাকত।
তখন রীতি ছিল আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার শেষ ফর্মা প্রেস-এ পাঠাবার চব্বিশ ঘণ্টা পর, অর্থাৎ তার পরের দিন দেশ-এর শেষ ফর্মা প্রেসে পাঠানো হত। এই দুটি পত্রিকারই শেষ ফর্মা ছিল গোড়ার দিকে সুবোধবাবুর গল্পের আট পৃষ্ঠা। সুবোধবাবুর ছিল ওই এক অভ্যেস, শেষ মুহূর্তের চাপ না পড়লে গল্প লিখতেই পারতেন না। কম্পোজিটর, প্রিন্টার, মেক-আপ ম্যান ছাপাখানা প্রভৃতি সবারই জানা ছিল যে শেষ ফর্মা ধরা আছে সুবোধবাবুর জন্যে এবং শেষ মুহূর্তে সুবোধবাবুর লেখা নিয়ে দুই পত্রিকায় দৌড়-ঝাপ শুরু হয়ে যাবে। প্রতি বছরেই পূজা সংখ্যার হিড়িক শুরু হবার আগেই সুবোধবাবুকে গিয়ে বলি এবার কিন্তু আপনাকে আগেই গল্প দিতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে সুবোধবাবু, জানিয়ে দেন-নিশ্চয়, নিশ্চয়। এবার আগেই লিখব। শেষ মুহূর্তে লিখি বলে আপনাদের অসুবিধা, আর আমিও গল্পটা যেভাবে গুছিয়ে লিখব বলে আরম্ভ করি তা আর হয় না, কোন রকমে শেষ করতে হয়।
আমরা জানি, সুবোধবাবুর সদিচ্ছা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর আগে গল্প লেখা হয়ে ওঠেনা। অন্তত গত বাইশ বছর ধরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম একবারও হয় নি।
সে-সময়ে প্রন-বি আনন্দবাজার পত্রিকায় সহকারী সম্পাদকের কাজ করতেন। পূজার লেখার কথা স্মরণ করিয়ে যখন তাকে বলতাম—বিশীদা, আপনার লেখাটা কবে দিচ্ছেন?
বরাভয়ের মুদ্রায় দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে বলতেন-ভয় নেই, সুবোধের আগে পাবে।
আজও বিশীদার কাছে যখনই পূজা সংখ্যার লেখা চাই–ওই একই উত্তর দিয়ে থাকেন। পূজা সংখ্যার কাজের শেষ দিনটা সুবোধবাবুকে যেমন উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয়, তার চেয়ে বেশী উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয় আমাদের।
পত্রিকার সাকুলেশন ম্যানেজার সদাব্যস্ত ভূপেনদা ঝড়ের মত ঘরে ঢুকেই ফেটে পড়লেন। চুল উস্কোখুস্কো, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বললেন–
আপনাদের জন্যই পূজার আগে পূজা সংখ্যা বেরোবে না। ফর্মা পাঠান নি, প্রেসের মেশিন খালি বসে আছে, এদিকে দশটা দপ্তরীকে কাজ দিয়েছি, তারাও হাত গুটিয়ে বসে। আমার কেবল ছুটোছুটি করাই সার।
ওদিকে পত্রিকার স্বত্বাধিকারী সুরেশচন্দ্র মজুমদার মশাই সাফ জবাব দিয়েছেন, মহালয়ার আগের দিন যদি পূজা সংখ্যা না বেয়োয় সে পত্রিকা তিনি আর বাজারে বের করবেন না, অফিসের গেট-এর সামনে ডাঁই করে পেট্রল দিয়ে সব কাগজ পুড়িয়ে ফেলবেন।
সে-যুগে প্রতি বৎসর শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে শেষ দিনে এই ধরনের হই-হল্লা, চেঁচামেচি, লম্ফঝম্ফ, শোরগোল বাঁধা বরাদ্দ ছিল। আর এ-সব না হলেও যেন ভাল লাগত না। শারদীয়া সংখ্যার কাজ অথচ চেঁচামেচি নেই, এ-যেন সেদিন আমরা কল্পনাই করতে পারতাম না। বিয়ে বাড়িতে শোরগোল না হলে যেমন তা বিয়ে-বাড়ি বলে মনে হয় না, আমাদের পূজা সংখ্যার কাজ খানিকটা ছিল সেই জাতের। এরও একটা উত্তেজনার দিক ছিল এবং সে উত্তেজনারও একটা নেশা ছিল। আজকের মত ঘড়ি-ধরা নিয়মবধা নির্বি পূজা সংখ্যার কাজ সেদিন ছিল না বটে, কিন্তু সেদিনের উন্মাদনার যে একটা আনন্দ ছিল আজ আমরা তা থেকে বঞ্চিত।
আবার সুবোধবাবুর কথাতেই ফিরে আসি। সুবোধবাবু আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, (যেমন প্রতি বৎসরই দেন) যে ওঁর গল্পের জন্য আট পৃষ্ঠা অর্থাৎ এক ফর্মা জায়গা রেখে দিতে। কম্পোজ করার পর যদি দেখা যায় গল্প আট পৃষ্ঠার ছোট হয়ে যাচ্ছে, বাড়িয়ে দেবেন, বড় হয়ে গেলে কেটে ছোট করে দেবেন। এদিকে রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা হয়ে আছে। গল্পের দেখা নেই কিন্তু আর্টিস্টকে দিয়ে হেডপীসের ছবি ও গল্পের নাম আঁকিয়ে ব্লক পর্যন্ত তৈরী।
গৌরাঙ্গ প্রেসের প্রভাতবাবুর টেলিফোন পাবার পর উদ্বেগ বেড়ে গেল। ওদিকে আনন্দবাজারের গল্প লেখা শেষ না হলে দেশ-এর গল্পে হাত দেবেন না—এটা জানা কথা। তাই আনন্দবাজার পূজা সংখ্যার সম্পাদক মন্মথবাবুকে টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার কতদূর?