ভারতের বাইরে থেকে এসেছেন এই সব সন্ন্যাসী, তাঁদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন :
এমন একদিন ছিল, যখন বহু বাধা অতিক্রম করেও প্রেমের বাণী ভারত থেকে বিশ্বের মানবের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজ আবার আপনাদের দেশের অধিবাসীবৃন্দ আমার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশবাসীর কাছে প্রেমের বাণী ও প্রীতি-উপহার বহন করে এনেছেন—এজন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
জমোৎসব অনুষ্ঠান শেষ হলে আশ্রমের অধিবাসীবৃন্দ সম্মিলিতকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন–
আমাদের শান্তিনিকেতন,
সে-যে সব হতে আপন।
সুমধুর কণ্ঠের এই গানের মধ্য দিয়ে আশ্রমবাসীদের প্রাণের আবেগ ও ভক্তি ফুটে উঠেছিল। এই আশ্রম তাদের একান্ত আপনার, এখানকার শ্যামল প্রান্তর, উম্মুক্ত নীলাকাশ, আম্রকুঞ্জে আলোছায়ার খেলা, বসন্তের পুষ্পমঞ্জরী এদের মনকে আকর্ষণ করে। যিনি এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, এই বিদ্যালয়ের প্রাণস্বরূপ তাদের সেই গুরুদেবকে আশ্রমবাসীরা শুধু শ্রদ্ধা ও ভক্তি দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখে নি, প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনে একান্ত আপনার জন বলে মনে করে। সকলের মধ্যে থেকে সবার অন্তরে তিনি আশা, উৎসাহ ও আনরসের যোগান দিয়ে থাকেন। ইনিই সেই শারদোৎসবের ঠাকুরদা, যাকে না হলে ছেলেদের খেলা জমে ওঠে না।
শাল বীথিকার মাথার উপর সন্ধ্যার চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ, তার স্নিগ্ধ কোমল রশ্মি নব-অঙ্কুরিত কচি পাতায় নৃত্য করে ফিরছে। আশ্রমের মাঝখানে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আলিম্পন অঙ্কিত একটি স্থান, নৃত্যের আসর। পাশেই গায়ক-গায়িকাদল বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উপস্থিত, দর্শকদল নাটমঞ্চের চারদিকে গোল হয়ে বসে গিয়েছে। এমন সময় রবীন্দ্রনাথ আসরের একধারে আপন স্থানে উপবেশন করতেই একটি আশ্রম-কন্যা অপূর্ব সুধাকণ্ঠে গেয়ে উঠল।
যা পেয়েছি প্রথম দিনে
সেই যেন পাই শেষে,
দুহাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই
শিশুর মত হেসে।।
মাথার উপর সীমাহীন আকাশ, চন্দ্রালোকে চারিদিক প্লাবিত। গানের সুর দক্ষিণের মাতাল সমীরণের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে।
গানের পর শুরু হল নৃত্যের পালা। তিনটি ছোট্ট মেয়ে খোলের তালের সঙ্গে আলপনা-আঁকা প্রাঙ্গণে আপন মনে নাচতে লাগল যেন চাঁদের দেশের তিনটি পরী মর্তের মাটিতে নৃত্যরতা।
এরপর রবীন্দ্রনাথ তার বহু পুরাতন রচনা সতী কবিতা আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তি শেষ হলে আরম্ভ হল বড়দের নাচ। নৃত্যের আখ্যানবস্তু দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা। গভীর অরণ্যে রাজা দুষ্মন্ত শিকার করে ফিরছেন, এমন সময় দেখলেন সখী পরিবৃতা শকুন্তলা আলবালে জলসেচন করছেন, পুষ্প চয়ন করে মালা গাঁথছেন, আশ্রম হরিণ-হরিণীকে আদর করছেন। সেতারের ঝঙ্কারের সঙ্গে নৃপুরনিকণে, সাবলীল দেহভঙ্গিমায়, মৃদঙ্গের তালে তালে দুষ্মন্ত শকুন্তলার প্রথম পরিচয় ও প্রেমের পরিণতির আখ্যানবস্তু নৃত্যছন্দে রূপায়িত হয়ে উঠেছিল। একে একে নৃত্যরতা অনসূয়া ও প্রিয়ম্বদা শকুন্তলাকে নিয়ে বিদায় হল, দুষ্মন্তও চলে গেলেন। শূন্য আসরে তখনও সেতারে বসন্ত-বাহারের সুর ভেসে আসছে।
শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশে একটি জন্মোৎসবের ছবি, যা আমার স্মৃতিপটে আজও অম্লান রয়েছে, আপনাদের কাছে তুলে ধরলাম।
কোন-কোন ব্যক্তি সখেদে বলেছেন, এ-যুগে এই পৃথিবীতে জন্মে পদাঘাতই শুধু তারা পেয়েছেন। আমি তাদের করুণা করি। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এই পৃথিবীতে জন্মে তুমি কি পেলে? আমার উত্তররবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ।
আমি রবীন্দ্র-যুগে জন্মেছি, রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছি। আমার এই লেখার পাঠকদের মধ্যে যারা এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত তারা হয়তো আমাকে ঈর্ষা করবেন, কিন্তু তার কোন হেতু নেই। সৃষ্টিকর্তা আপন সৃষ্টির মধ্যেই প্রকাশ। তার সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
তবু হয়তো অনুশোচনা নিয়ে প্রশ্ন করবেন আপনার মত চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য তো আমাদের হল না।
নাই বা হল। পঁচিশে বৈশাখ একটি পবিত্র দিন। মহানগরীর কলুষতার মধ্যে সেদিনটি না কাটিয়ে চলে যান শান্তিনিকেতনে। পূর্বপল্লীর প্রান্তে পারুলডাঙার মাঠে প্রভাত-সূর্যের প্রথম প্রকাশকে ধ্যানসমাহিত চিত্তে দেখুন, আদিত্যবর্ণ এক মহান পুরুষকে দেখতে পাবেন। তিনিই রবীন্দ্রনাথ।
২৩. সুবোধ ঘোষের থিরবিজুরী
অনেকদিন আগে এই বৈঠকেই কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ সম্পর্কে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম যে শেষ মুহূর্তে শারদীয়া সংখ্যায় একটি গল্প লিখে আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। আর সে কী গল্প! থিরবিজুরী। যেগল্প সে বছরের শারদ সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প বলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সে-গল্প লেখার পিছনে যে কাহিনী আছে তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি বিস্ময়কর। আর সুবোধবাবুর স্থৈর্য ও সংকল্পের যে পরিচয় সেদিন পেয়েছিলাম তা আজও আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঘটনা বলে মনে হয়, অলৌকিকও বলতে পারেন। সেই কাহিনীই আপনাদের কাছে আজ বলতে বসেছি।
ভাদ্র মাস হতে চলেছে, তখনও শেষ বর্ষণের পালা চোকে নি। বর্মণ স্ট্রীটের অফিসের এক প্রান্তে সুবিশাল কদম গাছে প্রস্ফুটিত কদম্বের সমারোহ। সেদিকে মাঝে মাঝে দৃষ্টি যে যেত না তা নয়, কিন্তু পরক্ষণেই সে-দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হত পুঞ্জীভূত প্রুফের গাদায়। পূজা সংখ্যার কাজের তাড়া ও দুশ্চিন্তা যখন ঘাড় ও মগজে বোঝার মত চেপে আছে তখন কলকাতা শহরের বড় বাজারে বসে কদম ফুল আর সজল মেঘের ছায়া দেখাটা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পূজা সংখ্যার কাজ তখন চরমে উঠেছে। প্রায় একমাস ধরে সকাল দশটা থেকে রাত দশটা কাটে একটা প্রবল উত্তেজনার মধ্যে। অমুক লেখকের লেখা এখনও এসে পৌঁছল না। লেখা এসে পৌঁছল তো কম্পোজ দিতে দেরি করছে। ওদিকে আর্টিস্টের কথা ছিল আজ বিকেল পাঁচটার মধ্যে গল্পের ছবি ও হেপী দিয়ে যাবার, তারও দেখা নেই। এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেসের ম্যানেজার প্রভাতবাবু টেলিফোনে তারস্বরে চিৎকার করে বলছেন—এখনও ফর্মা পাঠালেন না? মেশিন খালি বসে আছে, ফর্মা ঠিক মতন না পেলে এত ইম্প্রেশন আমি কী করে দেব? পূজা সংখ্যা আর বেরবে না।