বলতে বলতে স্তব্ধ হয়ে গেলেন কবিগুরু। কিছুক্ষণ পরে আবার বললেন–ঐ পারুলডাঙার মাঠের পূর্বাকাশে-ঐ দিগন্তে যেমন করে দেখতে পাই আমার জীবনের প্রতীক প্রভাত সুর্য, তা কি কলকাতা শহরের সৌধে বসে দেখতে পাবো? রাজ অট্টালিকার চেয়ে আমার সীমের লতার বেড়ায় ঘেরা শ্যামলী কুটীরই ভালো। মহানগরীকে আমি পাষাণগড়া পাষাণকারা বলেছি আর এখন সেই মহানগরীতেই আমার জন্মজয়ন্তী করার জন্য বিপুল অয়োজন চলছে।
আপনমনে কথাগুলি বলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। এ-আক্ষেপ আমাদের বলছিলেন তা নয়। তিনি যেন নিজের মধ্যে নিজেকেই বলছিলেন, খুব তন্ময় হয়েই বলেছিলেন।
এই ঘটনার উল্লেখ করার একটা কারণ আছে। কলকাতা শহরে পল্লীতে পল্লীতে পাল্লা দিয়ে যখন রবীন্দ্র জন্মোৎসবের নামে নাচ-গান-হল্লার হিড়িক চলে সেই সময় আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতনের শান্ত পরিবেশে রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালনের একটি সুন্দর দিন। তারই ছবি আজ এখানে তুলে ধরছি।
শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের খুব মন খারাপ। সত্তর বছরের জন্মোৎসব হবে কলকাতায়। রাজধানীর জনারণ্যে তাদের স্থান কোথায়? ছেলেমেয়েদের মুখে নীরব প্রতিবাদের ছায়া, চৈত্রের আম্রকুঞ্জে আর শাল বীথিকায় মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যায় না। তাদেরও বুঝি অভিমান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন এদের বঞ্চিত করে জয়ন্তী উৎসবের আনন্দই অর্থহীন। ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন–যে-মাসে আমি জন্মেছি সেই মাসের প্রথম দিনের সূর্যোদয়কে তো তোরা নববর্ষের উৎসবে আহ্বান জানাস, এবার তার সঙ্গে আমার জন্মোৎসবটাও জুড়ে দে।
আজ নববর্ষ, আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উৎসব। রাত্রির অন্ধকার তখনও দূর হয় নি। পূর্ণচন্দ্রের ম্লান আলো ঘুমন্ত আশ্রমের উপর স্বপ্নজাল রচনা করছে। ঘুমভাঙ্গা দু-একটি প্রভাত-পাখির ক্লান্ত কাকলীতে আম্রকুঞ্জ মুখরিত। এমন সময় বালক বালিকাদের সমবেত কণ্ঠের বৈতালিক গান আশ্রমের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হয়ে নীল আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। বৈতালিকদল আশ্রমের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে গান গাইলে—
জয় হোক্ জয় হোক্ নব অরুণোদয়।
পূর্বদিগঞ্চল হোল্ক জ্যোতির্ময়।
* * *
এস নব জাগ্রত প্রাণ,
চির যৌবন জয়গান।
এস মৃত্যুঞ্জয় আশা,
জড়ত্বনাশা,
ক্রন্দন দূর হো বন্ধন হোক্ ক্ষয়॥
নিদ্রামগ্ন আশ্রমবাসীকে জাগিয়ে দিয়ে বৈতালিক গান থেমে গেল। অন্ধকার দূর হয়েছে, প্রভাতরুণের কিরণসম্পাতে শাল বীথিকার নবীন কিশলয় হিল্লোলিত, বিহঙ্গম গীতছনে আমলকী কানন মুখরিত। আমের ছাত্রছাত্রী ও শিশুদের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে গিয়েছে, আজ নববর্ষ, আজ গুরুদেবের জন্মোৎসব।
মন্দিরে ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং ঢং। আশ্রমের অধিবাসীরা দলে দলে আসছে, গায়ে তাদের বাসন্তী রঙের চাদর, মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। আশ্রম বালকরা সার বেঁধে নিঃশব্দে নম্রপদক্ষেপে মন্দিরে প্রবেশ করল, প্রবেশদ্বারে একটি বালিকা ফুল দিয়ে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিল সবার কপালে। মন্দিরের ভিতর জনসমাগমে পূর্ণ, রবীন্দ্রনাথের অগিমন প্রতীক্ষায় সবাই উদগ্রীব।
সহসা ঘণ্টাধ্বনি স্তব্ধ। অদূরে শুভ্রবন্ত্রে আচ্ছাদিত রবীন্দ্রনাথের ঋষিসদৃশ সৌম্য শান্তমূর্তি দেখা দিল। বার্ধক্যের ভারে শরীর অনেকখানি ভেঙ্গে পড়েছে, তবু অনেকখানি পথ হেঁটে এসে তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন, আশ্রমবাসী নীরবে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাল। চন্দন রেখাঙ্কিত প্রশস্ত ললাট, কণ্ঠে শ্বেতপুষ্পের মালা। উপাসনার বেদীতে উপবেশন করলে কয়েকজন বালকবালিকা মিলিত কণ্ঠে গান ধরলেন—
তব অমল পরশ-রস শীতল শান্ত
পুণ্যকর অন্তরে দাও।
তব উজ্জ্বল জ্যোতি বিকাশি হৃদয়
মাঝে মম চাও।
সূর্যের রক্তিম আলোয় ধীরে পূব আকাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, দিনের প্রথম রশ্মি নববর্ষের আশীর্বাদ বহন করে কবিগুরুর শুভ্রললাট স্পর্শ করল। গান শেষ হলে উৎসবের সার্থকতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন–
মানুষের পক্ষে উৎসবের বিশেষ উপযোগিতা আছে। প্রতিদিনের কাজের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে মানুষ যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন এই ধরনের উৎসবানুষ্ঠান তাকে জীবনের প্রকৃত সত্তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত কণ্ঠে উপাসনার শেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে থামলেন, গানের দল গেয়ে উঠল।
সবাই যারে সব দিতেছে
তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।
কবার আগে চাবার আগে
আপনি আমায় দেব মেলি।
বাউল সুরের গানটির মধ্যে আত্মনিবেদনের যে-মন্ত্র মূর্ত হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ নিমীলিত নয়নে তা উপলব্ধি করেছিলেন।
উপাসনার শেষে সাদর সম্ভাষণ ও কোলাকুলির সাড়া পড়ে গেল। ছাত্ররা অধ্যাপক ও গুরুজনদের ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করছে, গুরুজন সহাস্যমুখে ছাত্রদের আশীর্বাদ জানাচ্ছেন। সহকর্মীরা পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে আলিঙ্গন করছেন।
আশ্রমবাসী ও অতিথি অভ্যাগত বহু নরনারী একে একে আম্রকুঞ্জে এসে সমবেত হল।
আম্রকুঞ্জের খানিকটা উম্মুক্ত প্রাঙ্গণ গেরুয়া মাটি দিয়ে লেপন করা, তাতে সুনিপুণ হাতের আলপনা আঁকা। অগুরু ধূপের স্নিগ্ধ গন্ধে প্রভাত সমীরণ আমোদিত। সুসজ্জিত বেদীতলে রবীন্দ্রনাথ এসে উপবেশন করলেন। আশ্রমের সংস্কৃত পণ্ডিতরা স্বস্তিমন্ত্র পাঠ করার পর শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের জনকয়েক বালকবালিকা নিজেদের হাতের তৈরী নানা শিল্পদ্রব্য ও চিত্র অর্ঘ্য সাজিয়ে তাদের প্রিয় গুরুদেবকে উপহার দিল। চীন, তিব্বত ও সিংহল থেকে সাধুরা এসেছেন শান্তিনিকেতনে। একে একে তারা নিজেদের ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করে কবিগুরুর শতায়ু কামনা করলেন।