এ-উৎসব ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ঘটেছিল ১৮৬১ সালে। ১৯৬১ সালের শুরুতেই বোম্বাই শহরবাসী খুব ঘটা করে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীর শুভ উদ্বোধন করলেন, সেই থেকে সারা বৎসরব্যাপী সারা দেশ জুড়ে উৎসব চলছে।
কলকাতা শহর একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। এই শহরের মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন, এই শহরের মাটিতেই তাঁর দেহাবসান ঘটেছে। সুতরাং ঘটা করে শতবার্ষিকী উৎসব পালনের অধিকার কলকাতা শহরের নিশ্চয় আছে। তাই রবীন্দ্রনাথের নামে বড় বড় ইমারত তৈরী হচ্ছে। রবীন্দ্র নাট্যশালা, রবীন্দ্র ভারতী, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র স্টেডিয়াম, রবীন্দ্র সরোবর ইত্যাদি কত কিছু। শুনছি রবীন্দ্রনাথের নামে শান বাঁধানো রাস্তা হবে, তার মোড়ে থাকবে রবীন্দ্রনাথের বিরাট মর্মর মূতি। অর্থাৎ ইট পাথর দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমরা বন্দী করতে চাই। শহুরে সভ্যতার এইটাই সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন বলেই শহর থেকে শত মাইল দূরে শান্তিনিকেতনের নির্জন প্রান্তরে তিনি তাঁর শান্তির নীড় রচনা করেছিলেন। শহরে শতবার্ষিকী উৎসবের যে পরিচয় ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখতে পাচ্ছি উৎসবপতি রবীন্দ্রনাথ পড়ে থাকেন নেপথ্যে। তাঁকে উপলক্ষ করে চলে নাচ-গান-নাটকের হুল্লোড়বাজি। কলকাতা শহরে পাড়ায়-পাড়ায় অলি-গলিতে কম্পিটিশন দিয়ে সরস্বতী পুজো হয়। লাউড স্পীকারে ঘুম তাড়ানো মাসিপিসির আধুনিক গান আর বিসর্জনের দিন রাস্তায় রীতে সরস্বতী মাঈ কী জয় ধ্বনির সঙ্গে রকবাজদের রক-এন-বোল নাচের মাতামাতি দেখে বড়োদের নিনে করে বলতে শুনেছি-আজকালকার ছোঁড়াগুলো গোল্লায় গেছে। বইয়ের সঙ্গে সারা বছর সম্পর্ক নেই, শুধু পূজোর নামে চাঁদা আদায় আর হই-হল্লা। কিন্তু সরস্বতীর বরপুত্র রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব নিয়ে বড়রা প্রতি বৎসর কলকাতা শহরে পাড়ায় পাড়ায় যে কাণ্ডটা করেন তার নিন্দা করে কে। সেখানেও সেই চাদা আর হই-হল্লা। ছোটরা তো বড়দের দেখেই শেখে।
শহরে উৎসবের নামে যে ভিড়, কোলাহল আর উচ্ছলতা দেখা দেয় তাতে শ্রদ্ধার চেয়ে উন্মত্ততাই থাকে বেশী। উৎসব সুন্দর না হয়ে বিকৃত হয়ে পড়ে। শহুরে উৎসবে এই রুচির বিকার রবীন্দ্রনাথের মনকে পীড়া দিত, তিনি এড়িয়ে চলতেন। একটি ছোট্ট ঘটনা বলি।
রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জয়ন্তী উপলক্ষে স্থির হয়েছে কলকাতায় খুব ঘটা করে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। প্রস্তাবটা যখন তাকে দেওয়া হল তিনি কিছুতেই সম্মতি দিতে রাজী হলেন না। নাগরিক সম্বধনকে তাই ঠাট্টা করে বলতেন সংবর্ধনা। অর্থাৎ ওখানে গিয়ে সং সাজতে ওঁর আপত্তি। অবশেষে রবির কাছে আবেদন নিয়ে দুই চন্দ্রের উদয় হল। জগদীশচন্দ্র ও শরৎচন্দ্র। প্রথম জন রবীন্দ্রনাথের অভিন্নহৃদয় বন্ধু, দ্বিতীয়জন সমধর্মী অনুজসাহিত্যিক। এদের অনুরোধ এড়াতে পারলেন না, মত দিতেই হল। মত দেবার পর থেকেই দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সত্তর বৎসরের জয়ন্তী উৎসবের উদ্যোগ আয়োজনের খবর যত আসছে ততই তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
সেই সময় কবি নিশিকান্তর প্রায়ই ডাক পড়ত। নিশিকান্তকে রবীন্দ্রনাথ স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। নিশিকান্তর দুটি পরিচয়। কাব্যরসিক ও ভোজন-রসিক। দুটির প্রতিই তার সমান আগ্রহ, পাল্লায় এদিক ওদিক হবার জো নেই। নিশিকান্তকে ডেকে এনে দুটি রসেরই যোগান দিতেন রবীন্দ্রনাথ, নিশিকান্ত ধ্যানস্থ হয়ে দুটি রসই সমান উপভোগ করত।
কবিগুরুর সত্তর বছরের জয়ন্তীর সময় নিশিকান্ত শান্তিনিকেতনে ছিল, তখনও পণ্ডিচেরী যায় নি। জয়ন্তীর মাসখানেক আগে—তখনও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেই সময়ে রোজ সকালে নিশিকান্তকে যেতে হত তার কাছে। না গেলে, একান্ত ভৃত্য বনমালীকে দিয়ে পাকড়াও করাতেন, কখনও বা একান্ত সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে পাঠিয়ে দিতেন নিশিকান্তর ঘরে, তাকে উত্তরায়ণে হাজিরা দেবার জন্যে। হাজিরা দিতে হত।
একদিন সকালে নিশিকান্তর ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় উত্তরায়ণের সাইকেল-বেয়ারা চতুর এসে নিশিকান্তকে বললে—শিগগির চলুন, বাবুমশাই আপনাকে ডাকছেন।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তলব এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে নিশিকান্ত বললে—তুই-ও চ, আজকাল গেলেই গুরুদেব সন্দেশ খাওয়ান, বড় বড় সাইজের।
এসব ব্যাপারে আমি তো এক পা তুলেই আছি। দুজনে গুটিগুটি উত্তরায়ণে গিয়ে হাজির।
নিশিকান্তকে দেখা মাত্রই উৎফুল্ল হয়ে বললেন–এই যে কান্তকবি, তোরই প্রতীক্ষায় বসে আছি। এই দ্যাখ, কত কবিতা এসেছে।
জয়ন্তী উপলক্ষে আসা বহু বাঙালী কবির কবিতা রবীন্দ্রনাথ একে-একে নিজেই পড়ে শোনাতে লাগলেন। ওদিকে বনমালী ততক্ষণে এক প্লেট মেঠাঁই সামনে ধরে দিয়েছে, কবিতা শুনতে শুনতেই তার সদ্ব্যবহার চলছে।
কবিতা পড়া শেষ হলে পর একটি চিঠি আমাদের পড়ে শোনালেন, কলকাতাবাসী একজন রবীন্দ্র-ভক্ত তাকে চিঠিতে দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়ে জানিয়েছেন যে, কলকাতায় জয়ন্তীর আয়োজন কী ঘটা করেই না হচ্ছে। টাউন হলে বিরাট মিটিং-এর আয়োজন, কলকাতায় শতাধিক বিখ্যাত ব্যক্তির স্বাক্ষর করা মানপত্র, কোন কোন্ প্রতিষ্ঠান মাল্যদান করবে ইত্যাদি এক বিরাট তালিকা।
চিঠিটা পড়া শেষ করেই রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন—আমার জয়ন্তী এই শান্তিনিকেতনে মানাত ভালো। আমি যে নিসর্গ প্রকৃতির শোভা ভালবাসি, স্বভাবসুন্দরীই যে আমার মানসসুন্দরী, তা কে না জানে? একটি ছোট মেয়ে আমাকে মালা-চন্দন দেবে, তোরা সকলে পুষ্পার্ঘ্য দিবি, শাস্ত্রীমশাই আর ক্ষিতিবাবু মন্ত্রপাঠ করবেন, গানের দল গান করবে। কেউ হয়তো একটা কবিতা আবৃত্তি করল। শঙ্খ বাজল, ঘৃত-প্রদীপও আছে। ধূপের গন্ধের সঙ্গে ফুলের গন্ধে মিশে রইল আমার জন্মদিন।