অনুমান যে মিথ্যে হবে না তা আগেই জানা ছিল। প্রথম কাপ চা-খেয়েই বুঝেছিলাম, পাকা হাতের তৈরি। গল্পের সুত্র ধরিয়ে দিয়ে বললাম—বাজার। করার বিড়ম্বনা থেকে কি ভাবে রেহাই পেলেন সেই ঘটনাটা বলুন।
উৎসাহিত হয়ে উঠলেন জগদীশবাবু। বললেন–মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। সে ঘটনার কথা ভাবলে আজও হাসি পায়। একদিন বিকেলে আদালত থেকে এক গাদা নথিপত্র বাণ্ডিল বেঁধে বাড়ি নিয়ে এলাম। গৃহিণী অবাক হয়ে সুধোলেন-এ সব খাতা পত্তর কিসের, উত্তরে বললামআদালতের কাজ। মামলা-মোকদ্দমা অনেক জমে গিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কড়া হুকুম তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দেওয়া চাই।
গিন্নী জানতেন, রাত্রে আমি এসব কাজ করতে পারি নে, চোখে কম দেখি। একমাত্র সময় সকাল বেলা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা-জলখাবার খেয়ে আদালতের নথি-পত্র নিয়ে বসি মুহুরীর কাজে, বাজারে যায় কাছারির সেই বেয়ারা।
একটা দিক তো রক্ষা হল। সকালে আর এক মাইল ধুলো-কাদা ভেঙ্গে বাজারে যেতে হয় না। কিন্তু রোজ সকালে ঘণ্টার পর ঘন্টা আদালতের নথিপত্র ঘাটা, তারও তো মানসিক যন্ত্রণা কম নয়। শেষে বাধ্য হয়ে লিখতে শুরু করে দিলাম। বোজ সকালে বসে লিখি, গৃহিণী ভাবেন কর্তা আমার আপিসের কাজে কী খাটাই না খাটছেন।
লিখতে লিখতে একদিন নিজেই আবিষ্কার করলাম যে একটা ছোটো গল্প লিখে ফেলেছি। গিন্নীকে না জানিয়ে গোপনে লেখাটা পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকার সম্পাদকের নামে এবং তা যথা সময়ে প্রকাশিতও হল।
জগদীশবাবু, এইটুকু বলেই চুপ করলেন, আমিও নির্বাক। বেলা বেড়েছে, শীতের মিঠে রোদ তখন কড়া হয়ে উঠেছে। আমি ভাবছিলাম যে-মানুষ লেখক হবার জন্যে কোন সাধনাই কখনও করেন নি তার হাত দিয়ে এমন লেখা বেরলো কি করেহয়তো মনে মনে অনেককাল ধরে এ-লেখার প্রস্তুতি চলছিল নিজের অগোচরেই। বিরাট বিস্ময় নিয়ে সেদিন জগদীশবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছি। আর কখনও ওঁর সঙ্গে দেখা হয় নি। পরবর্তী জীবনে যখন কলকাতায় এসে পত্রিকা-সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত হই তখন জগদীশবাবু কলম থামিয়ে দিয়েছেন। পরিমিতি বোধ ছিল তার অপরিসীম। পাঠকদের মন-যোগানো লেখা কোনদিন তিনি লেখেন নি। যে মুহূর্তে জানতে পারলেন যে তার স্পষ্টোক্তি পাঠকদের মনোরঞ্জন করতে পারছে না, লেখা দিলেন থামিয়ে। শারদীয়া সংখ্যার জন্য একবার লেখা চেয়ে ওঁকে চিঠি দিয়েছিলাম। উত্তরে কম্পিত হস্তাক্ষরে প্রায় অস্পষ্ট ছোট্ট একটি চিঠি এল—সাহিত্য কর্ম হইতে অনেক দিন হইল বিদায় লইয়াছি। পুজি ফুরাইয়াছে, দৃষ্টিশক্তিও হারাইয়াছি। ভগবান যাহা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। ইতি।
১৯৫০ সালে জগদীশবাবুর ছোটগল্পের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। প্রকাশকের অনুরোধে সে-গ্রন্থের একটি ভূমিকা তিনি লেখেন। তার এক জায়গায় নিজের রচনা সম্বন্ধে যে কথা লিখেছেন তা এখানে উদ্ধৃত করে দিলাম :-
নিজের সম্বন্ধে আমি যতই ফেনাইয়া ফাঁপাইয়া ফলাইয়া লিখি না কেন কোন সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি তাহা গ্রহণ করিবেন না; হয়তো হাসিবেন এবং হাসাহাসি করিবেন। আর, অনুপস্থিত লোকের হঠাৎ আসিয়া গাম্ভীর্যের সঙ্গে বাগাড়ম্বরপূর্বক সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা, দায়িত্ব, স্থায়িত্ব উদ্দেশ্য প্রভৃতির ব্যাখ্যা করা হইবে ততোধিক হাস্যের কারণ।
তবে একেবারেই যে খবর নাই কিম্বা সব খবরই যে বলিতে আমি অনিচ্ছুক এমন নয়। একটি খবর দিব।
বোলপুর টাউনে গেলাম। কিছুদিন পরেই মাসিক পত্রের মাধ্যমে ক্রমে জানাজানি হইয়া গেল যে আমি একজন লেখক। দুটি বন্ধু পাইলাম। শ্ৰীভোলানাথ সেনগুপ্ত ও শ্রীশান্তিরাম চক্রবর্তী। তৎপূর্বেই ভোলানাথবাবু তার রচিত গোরুর গাড়ী কাব্য ছাপাইয়াছেন। ওই দুটি বন্ধুর মানুষের অন্তরের তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করার অসাধারণ শক্তি দেখিয়া এবং তাঁদের রসাল রসিকতায় মুগ্ধ হইয়া গেলাম। তাহারাই একদিন প্রস্তাব করিলেন : গল্পের বই করুন একখানা।
জানাইলাম, প্রকাশক পাইব না।
সেখানেই উপস্থিত ছিলেন সেখানকার কানুবাবু-শ্ৰীব্রজজনবল্লভ বস্তু। তিনি জানিতে চাহিলেন : ছাপিতে কত টাকা লাগিতে পারে?
বলিলাম—শ-আড্ডাই।
–আমি দিব। ছাপুন।
কানুবাবু যথাসময়ে টাকাটা দিলেন—বিনোদিনী গল্পের বই ছাপা হইল।
২০২৫ খানা বই একে-ওঁকে দিলাম। অবশিষ্ট হাজারখানেক বই, আমার আর কানুবাবুর বিনোদিনী, প্যাকিং বাক্সের ভিতর রহিয়া গেল; পরে কীটে খাইল।
লেখক এবং সামাজিক মানুষ হিসাবে আমার আর কোনও অনুশোচনা নাই, কেবল মানসিক এই গ্লানিটা আছে যে, কানুবাবুর শ-আড্ডাই টাকা নষ্ট করিয়াছি।
আমার নিজের সম্বন্ধে আর একটি কথা এই যে, আমি যদি এখন মরি তবে যাহারা আমাকে চেনেন তাহারা বলিবেন-বয়েস পেয়েই গেছেন।?
এই ভূমিকা লিখে দেবার কয়েক মাস পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে তারই অনুজ-সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র এক জায়গায় বলেছেন :
সময়ের স্রোতে সব কিছুই হারায়, তবু জীবনকে নির্ভীক নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখবার ও বুঝবার চেষ্টায় অসাধু সিদ্ধার্থের মত বই লেখবার জন্যে সারাজীবন রোগ শোক অভাব দারিদ্র্যের সঙ্গে অম্লান বদনে যিনি যুঝে এসেছেন, প্রত্যক্ষভাবে না হোক, তাঁর সাহিত্যিক সাধুতা পরোক্ষভাবে ভাবী কালের অনুপ্রাণনা হয়ে থাকবেই।
২২. আমরা যে-যুগে জন্মেছি
আমরা যে-যুগে জন্মেছি সে যুগকে বলা উচিত রবীন্দ্র-যুগ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কী না দিয়েছেন। মুখে ভাষা দিয়েছেন, কণ্ঠে গান দিয়েছেন, প্রাণে দিয়েছেন আনন্দ, আর দিয়েছেন পৃথিবীর সৌন্দর্যকে মন ভরে দেখার দৃষ্টি। একশ বছর আগে এই বাংলা দেশের আকাশে যার আবির্ভাব ঘটেছিল একশ বছর পার হয়ে এসে তার আলো আজ সারা পৃথিবীর আকাশকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। আজ তাই পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এক প্রাণ এক মন হয়ে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিক জন্মোৎসব পালনের আয়োজন করেছে।