এইটুকু বলেই জগদীশবাবু আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। অবশেষে গলার স্বরটা আরও একটু নিচু করে বললেন–পরের বাড়ির মেয়েকে বিদেশে বিভুইয়ে এনে রেখেছি। এখানে আবার সঙ্গীসাথীর বড়ই অভাব। থাকলেও তারা শুধু হাঁড়ির খবর নিতেই ব্যস্ত। গৃহিণী তাই ওদের বেশি পছন্দ করেন না, অগত্যা আমাকেই সঙ্গ দিতে হয়।
একমাত্র সময় এই সকাল বেলা। এ-সময়টা গিন্নী রান্নাবান্না, ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, আদালতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সময়টা আমার নিজস্ব। একে আমি আমার ইচ্ছে মত শুয়ে বসে বই পড়ে অথবা সামনের ওই পথ দিয়ে লোকের আনাগোনা দেখে কাটিয়ে দিই। কিন্তু আমাদের এই কেরানী জীবনে সংসারটা এমনই জোয়াল যে একবার কাঁধে চড়লে আর নামতে চায় না, চব্বিশ ঘণ্টাই তোমাকে খাটাতে চায়। তখন রাম প্রসাদী গানে সান্ত্বনা খোঁজা ছাড়া আর উপায় কি।
জগদীশবাবু এবার থামলেন। বাটিভর্তি মুড়ি আর গুড় ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গিয়েছে, দু-পেয়ালা চা এসে হাজির। চায়ে চুমুক দিয়ে জগদীশবাবু আবার শুরু করলেন তার লেখক-হওয়ার কাহিনী।
কাছারির একটা বেয়ারা রোজ সকালে এসে কুয়ো থেকে জল তুলে দিয়ে যায়। গৃহিণী তাকে দিয়েই এতদিন চাল-ডাল-নুন-তেল বাজার থেকে কিনিয়ে আনেন, সপ্তাহে দুদিন হাটে গিয়ে কঁচা বাজারটাও ও-ই করে আনে। গৃহিণীর ধারণা, লোকটা নির্ঘাৎ পয়সা চুরি করে। শুধু তাই নয়, হাটের দিন যত রাজ্যের রদ্দি ঝড়তি পড়তি শুটকো আনাজ কিনে এনে দাম বলে বেশি। সুতরাং এখন থেকে ও-কাজটা আমাকেই করতে হবে।
আমি চিরকালই একটু আয়েশী লোক কিন্তু গিন্নীর ধারণা আসলে আমি নাকি কুঁড়ের হদ্দ। সুতরাং এই দুর্নাম ঘোচাবার জন্য পরদিন সকাল থেকেই বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে পড়লাম। তার কি পরিণাম হয়েছিল জান? গিন্নীর দু-চার পয়সা সাশ্রয় হয়েছিল ঠিকই, আমার বিড়ি-সিগারেটের পয়সায় টান পড়ে গেল। বাজারের ওই ভিড়ের মধ্যে তরিতরকারির দর নিয়ে দরাদরি করা কি আমার দ্বারা সম্ভব?
বাজার করে আসা মাত্রই গৃহিণী থলি উপুড় করেই বললেন—বেগুন কত করে সের আনলে?
—চার পয়সা করে।
চোখ বড় বড় করে গিন্নী বললেন–ও মা, কী কাণ্ড বল তো? এতদিন রামচরণ ছয় পয়সা করে বেগুন এনেছে, তা-ও বিচিভর্তি। কী পয়সাটাই না এতদিন ধরে সরিয়েছে।
জগদীশবাবু হাসতে হাসতে বললেন—এই ভাবে ঝঞ্জাট এড়াতে নিজের পকেট খরচার পয়সায় তো টান পড়লই উপরন্তু কাছারির নির্দোষ বেয়ারাটা মাঝখান থেকে বদনামের ভাগী হল। তার চেয়েও মারাত্মক কাণ্ড কি হল জানো? পাশের বাড়ির মোক্তার গিন্নীর কাছে আমার গিন্নী সগর্বে জানিয়েছেন দরাদরি করে কত সস্তায় আমি বাজার করে আনি। তার ফলে মোক্তার-গিন্নী তাঁর বাড়ির চাকরকে বরখাস্ত করে স্বামীকেই হাটে পাঠাচ্ছেন। তার অবস্থাটা একবার অনুমান করে দ্যাখ। একদিন মোক্তার বাবুর সঙ্গে বাজারে আমার দেখা। একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা। আমাকে দেখেই কঁদো-কাদো মুখে বললেন–আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি জগদীশবাবু যে আমার এই সর্বনাশটা করলেন।
সান্ত্বনা দিয়ে বললুম-দুঃখটা একা ভোগ করতে বেশি লাগে। ভাগ করে ভোগ করলে কষ্টের অনেকখানি লাঘব হয়।
ভদ্রলোক কি বুঝলেন জানিনা, তবে অনেক দিন বাক্যালাপ বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু আসল বিপদ দেখা দিল কখন জানো? আমার কেনা তরি-তরকারি গৃহিণীর আর পছন্দ হয় না। বাজার করে আনার পর থলিটা উপুড় করে বললেন—তোমাদের কাণ্ডজ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে। লাউ এনেছ যখন কুচো চিংড়ি কোথায়?
–বাজারে চিংড়ি আজ ওঠেই নি।
–ই বা কাতলা মাছের একটা মুড়ো আনলেও তো পারতে।
–মাছের মুড়ো সব সময় আলাদা না পাওয়া গেলে কি করব?
–ধনে পাতাও তো আনতে পারতে। বল, সেটাও বাজারে ওঠে নি।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে জগদীশবাবু আমাকে বললেন–বাজারে গিয়ে ফাকা জায়গা দেখে হাতের কাছে যা পাই কিনে আনি, গিন্নীর আর পছন্দ হয় না। এদিকে বিড়ি সিগারেট খাওয়া গেল কমে, ওদিকে বোজ সকালে এই গলদঘর্ম পরিশ্রম। উপরন্তু তরিতরকারির পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বোজ একটা বচসা। জীবনে যখন প্রায় ঘেন্না ধরিয়ে দেবার উপক্রম হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
জগদীশবাবু টিনের একটা চ্যাপটা কৌটো থেকে বিড়ি বার করে ধরিয়ে বললেন—আরেক কাপ চা হয়ে যাক, কি বলে?
আমি তৎক্ষণাৎ সায় দিলাম। একে শীতের সকাল তার উপর জগদীশ বাবুর এমন সরস গল্প। চা-টা জমবে ভালো। আমার সম্মতি পেয়ে জগদীশবাবু ধীর পদক্ষেপে আবার বাড়ির ভিতরে গেলেন। একটু পরে বেরিয়ে এসেই বললেন–গিন্নী জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে বসে এত বকর বকর করছ আর বার বার চা খাওয়াচ্ছ। ছেলেটা কে? যেই বললুম শান্তিনিকেতনের ছেলে, আমার লেখা পড়ে যেচে আলাপ করতে এসেছে, গিন্নীর মুখে একগাল হাসি। সুতরাং চা-টা ভালই তৈরি হবে অনুমান করছি।
মানুষটির কথা-বার্তায়, আচার আচরণে সরল অন্তকরণের এমন একটা কোমল স্পর্শ আছে যা আমাকে এতক্ষণে অভিভূত করে ফেলেছে। আমি সংকোচের সঙ্গেই বললাম—আমি এসে আপনার কাজের কোন রকম ব্যাঘাত করলাম না তো?
জগদীশবাবু বললেন—খুব কাজের মানুষ ঠাওরেছ আমাকে। বৈষয়িক উন্নতির জন্য যারা কাজ করে তৃপ্তি পায়, আমি সে-দলের নই। তার চেয়ে তোমার সঙ্গে দু-দণ্ড বসে গল্প করায় আমি অনেক বেশি তৃপ্তি পাই।
দু-পেয়ালা চা এসে হাজির। চুমুক দিয়েই বললেন—অনুমানটা ঠিক কিনা বলল।