ধীর পদক্ষেপে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। দীর্ঘাকার ক্ষীণদেহটি ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। চেহারায় ইস্পাতের কাঠিন্য নেই, আছে জীবনসংগ্রামের ক্লান্তি। ঝঞ্চাবিক্ষুদ্ধ রাত্রির অবসানে পরিশ্রান্ত লতাবৃক্ষের মত। একটু পরেই একটা মোড়া হাতে বেরিয়ে এসে বললেন, শীতের সকালে স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে আলাপ জমবে না, রোদে পিঠ দিয়েই বসা যাক। কি বলো?
আমি তাড়াতাড়ি ওঁর হাত থেকে মোড়াটা নিয়ে ওর পাশে বসেই বললাম—আপনি এত কাছে থাকেন তবু শান্তিনিকেতনে আপনাকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথের কাছে অনেক লেখকই তো আসেন, আপনি কেন আসেন না।
চুপ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললেন–প্রতিদিন ভোরে উঠে আমি প্রথমে সূর্য-প্রণাম করি। আসলে সে প্রণাম কবিগুরুর উদ্দেশ্যেই। তবে কি জানো, অতবড় একজন মহাপুরুষের কাছে আমার যেতে বড়ই সংকোচ। আমার মুখ দিয়ে তো কোন কথাই বেরোবে না।
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম—আপনার এই সংকোচ কিন্তু অহেতুক। আপনার মত লেখক রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলে উনি খুশীই হবেন আপনার সঙ্গে আলাপ করে।
সলজ্জভাবে জগদীশবাবু বললেন–আসলে তো আমি লেখকই নই। লেখক হতে হলে যে নিষ্ঠা, যে সাধনা, যে অনুশীলনের প্রয়োজন আমি তার কিছুই করি নি। তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই, স্রেফ ফোকটে আমি লেখক হয়ে পড়েছি। আমার এই জোচ্চুরিটা পাছে ধরা পড়ে যায় সেই কারণেই কোথাও যেতে আমার এত ভয়।
জগদীশবাবুর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট যা আমার চোখে ধরা পড়েছিল তা হচ্ছে সাহিত্যিক সততা। সমাজের নিম্নস্তরের তুচ্ছ মানুষগুলিকে দেখেছেন অন্তরের গভীর সহানুভূতি দিয়ে। সে-দেথায় কোন ফাঁক বা ফাঁকি নেই এবং সেই সব চরিত্র নিয়ে ওঁর লেখার দৃষ্টিভঙ্গী যেমন তির্যক তেমনি খাঁটি সোনার মত উজ্জল। আমি তাই ওঁর কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম-আপনার লেখা আমি যতটুকু পড়েছি তাতে কিন্তু আপনার কথায় কোন রকমেই সায় দিতে পারছি না। আপনার লেখায় ব্যঙ্গ আছে, কষাঘাত আছে কিন্তু এ-সব ছাড়িয়ে যেটা বড় হয়ে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে অন্তর-মথিত দরদ আর সত্যদৃষ্টি।
মৃদুকণ্ঠে হতাশার সুর এনে জগদীশবাবু বললেন—আমার লেখা সাধারণ মানুষের যদি ভাল লেগে থাকে আমি তাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু বিদগ্ধজনের কাছে এ-লেখা অপাংক্তেয়।
আমি বললাম-সাহিত্যে যারা মননশীল লেখককে খোঁজেন আমি তাদের দলে নই। সাহিত্যে সত্যদৃষ্টিই আমার কাছে বড় কথা।
এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে একটি সাঁওতালী বুড়ি ঝি একটা কাঁসার জামবাটি ভর্তি মুড়ি আর ঝোলা-গুড় এনে হাজির। জগদীশবাবু বললেন–শীতকালে খেজুরের গুড় আর মুড়ি বড় উপাদেয় খাদ্য। গিন্নী তোমার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে একটু নারকোল কুচি পড়লে আরও উপাদেয় হত। কি বল? বাড়িতে বোধ হয় আজ নারকোল নেই। তা না হলে গিন্নী এ-ভুল করতেন না।
আমি ততক্ষণে গুড়-মুড়ি ভাল করে মেখে বেশ খানিকটা মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে বললাম-বীরভূমের ঝোলা-গুড় আর মুচমুচে মুড়ির তুলনা হয় না।
হাসতে হাসতে জগদীশবাবু বললেন—তাই তো বলি সুকুমার রায় আবোল-তাবোল-এ পাউরুটি আর ঝোল-গুড়ের প্রশস্তি করেছেন। ঝোলাগুড় আর মুচমুচে মুড়ি তো খান নি।
যে প্রসঙ্গ আমাদের চলছিল সেই প্রসঙ্গেই আবার ফিরে আসার আশায় আমি বললাম—আপনার নিজের লেখা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাসের এই অভাবটা কিন্তু আমার মোটেই ভাল লাগছে না।
কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন জগদীশবাবু। ঝুকে পড়ে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা কিছু চিন্তা ওঁর মনকে আলোড়িত করছে তা অনুমান করলাম। একটু পরেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই দেখি শিশুর মত সরল হাসিতে ওঁর মুখ উজ্জ্বল, দুটি চোখে কৌতুক মাখা। বললেন—আমার সম্বন্ধে তোমার যখন এতই কৌতূহল, তোমার কাছে কথাটা খুলেই বলি। লেখক আমি কোন কালেই হতাম না। লেখক হওয়াটা আমার জীবনে এমন একটা কিছু স্মরণীয় ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা।
এটুকু বলেই বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে গলার স্বরটা কিঞ্চিৎ মৃদু করে বললেন–আমার গিন্নীই আমাকে লেখক বানিয়ে ছেড়েছেন।
আমি হেসে বললাম-এ আর নতুন কথা কি। বহু লেখকের জীবনে শুনেছি স্ত্রীর ইন্সপিরেশনই তার লেখক হবার মূল কারণ।
-তবে আমার ক্ষেত্রে কিন্তু ইন্সপিরেশন নয়, পারসপিরেশন। এই পারসপিরেশন থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে লেখক হতে হয়েছে। বৃত্তান্তটা বলি শোন।
আদালতে সামান্য বেতনের চাকরি, আয় এবং ব্যয়ের দুই প্রান্তের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে গৃহিণী নাজেহাল। শেষে একদিন বিরক্ত হয়েই আমাকে জানালেন—রইল তোমার এ ঘর দুয়ার, তুমি আদালতের চাকরি নিয়েই থাক, আমি চললাম।
প্রমাদ গণলাম। ঝড়ের পূর্বাভাস। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে খুলেই বল না।
গৃহিণী বললেন–বলব আর কি। চোখে দেখতে পাও না? রোজ সকালে কুঁড়েমি না করে নিজে গিয়ে হাটবাজারটা করলেও তো দু-পয়সা সাশ্রয় হয়।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত। ওই বাজার করাটা আমি বড় ভয় করি, ওটা আমার ধাতে সয় না। এখান থেকে বোলপুরের বাজারটা প্রায় এক মাইল পথ। ধুলো-ওড়া রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে বাজার করতে যাওয়ার বিড়ম্বনা কি কম। হাঁটুভর্তি ধূলো তো আছেই, তার উপর বাজারে লেপটালেপটি ভিড়। ওই ভিড় আমি কোন কালেই সহ্য করতে পারি নে বলেই এই মফস্বল শহরের এক প্রান্তে নিরিবিলিতে পড়ে আছি। তার উপর এক পয়সা সাশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন দরাদরি করে বাজার করার চেয়ে ডাকাতি করা বোধ হয় অনেক সহজ। তাছাড়া কি জানো? সকাল বেলাটাই হচ্ছে আমার কাছে মৌজ করার উৎকৃষ্ট সময়। সারা দিন তো আদালতে দিনগত পাপক্ষয় করছি কলম পিষে। ও-সময়টা পেটের ভাত যোগাড়ের জন্যে জন্মাবার আগে থেকেই বিধাতা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। আর রাত্রিটা