সরকার মশাই ততক্ষণে পকেট থেকে নোটবুক-পেনসিল বার করে দশদফা ফর্দ টুকে ফেলেছেন। দুগ্ধফেননি শয্যায় গা এলিয়ে দিয়ে জলধরদা বললেন–আজ আর বেড়াতে যাবার ইচ্ছে নেই, শরীরটা খুবই ক্লান্ত। আপনি বরং রাত্রে খাবার সময় আমায় ডেকে নিয়ে যাবেন।
সরকার মশাইকে বিদায় দিয়ে জলধরদা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন। ভাবনা আর কিছুই নয়, রাত্রে রাজার সঙ্গে দেখা হলে কথাটা কী ভাবে পাড়বেন মনে মনে তারই রিহার্সল দেওয়া।
যথা সময়ে সরকার মশাই এসে জানালেন, খাবার সময় হয়েছে-রাজা অপেক্ষা করছেন। জলধরদার সেই রাজকীয় পোশাক। গলাবন্ধ কোট আর কাধের উপর ভাঁজ করা চাদর। চাদরের আড্ডালে বগলের নীচে কাগজমোড়া বইয়ের বাণ্ডিলটা নিতে ভোলেন নি।
ঝাড় লণ্ঠন আলোকিত রাজবাড়ির প্রশস্ত প্রকোষ্ঠ পার হয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখেন একটা লম্বা টেবিলের একপ্রান্তে সৌম্যদর্শন রাজা তারই অপেক্ষায় বসে আছেন। চেয়ার থেকে উঠে স্মিতহাস্যে অভ্যর্থনা জানিয়ে টেবিলের অপর প্রান্তে বসবার জন্য আহ্বান জানিয়েই ভোজ্যবস্তু পরিবেশনের জন্য সরকার মশাইকে আদেশ জানালেন
কাল সকালে ওঁকে একবার নদীর ধার এবং তার পাশের গ্রামগুলি বেড়িয়ে নিয়ে আসবেন।
জলধরদা খেতে খেতে বললেন–আপনি ব্যস্ত হবেন না, গ্রাম দেখতেই তো আমার আসা। শৈশব কৈশোর আমার গ্রামেই কেটেছে তাই গ্রামের টান আমার প্রাণের টান।
আহারান্তে লালগোলাধিপতি বিদায় চেয়ে জানালেন পরদিন সকালে যেন জলধরদা তার সঙ্গে চা-পান করেন। প্রয়োজনের কথাটা বলতে গিয়েও সঙ্কোচবশত বলা হয়ে উঠল না, সুযোগই বা পেলেন কোথায়। আহারান্তে বিষণ্ণচিত্তেই শয্যা গ্রহণ করলেন।
রাত আর কাটে না। কখন সকাল হবে, জলধরদা তারই প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছেন।
অবশেষে দুঃখের রাত্রি অবসান হল। সরকার মশাই এসে ডেকে নিয়ে গেলেন চায়ের আসরে। জলধরদার সেই এক বেশ। গলাবন্ধ কোট, কাঁথে চাদর, বগলের তলায় উপন্যাসের বাণ্ডিল।
লালগোলার রাজা তারই প্রতীক্ষায় বসেছিলেন। পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—রাত্রে ঘুমের ব্যাঘাত হয় নি তো?
কিছুমাত্র না। একথা বলেই আর কালক্ষেপ না করে বগলের তলা থেকে বাণ্ডিলটা বার করে রাজার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন—আমি তো যেতেই বসেছি, এই আমার শেষ কাজ। আপনার নামেই
আহা-হা, হা হা, সে পরে হবে। এখন চা খান। শশব্যস্ত হয়ে জলধরদার কথার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন লালগোলারাজ যোগেন্দ্রনারায়ণ।
সরকার মশাইকে বললেন গ্রামটা একবার ঘুরিয়ে দেখাতে এবং সেই সঙ্গে বললেন–জলধরবাবু দুপুরে এবং রাত্রে কি কি খেতে ভালবাসেন সব তার কাছ থেকে জেনে নিয়ে সেই রকম ব্যবস্থা করবেন। আচ্ছা জলধরবাবু, আমি তাহলে এখন উঠি। দুপুরে খাবার সময় আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
বইয়ের বাণ্ডিলটা চাদরের তলায় ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে জলধরদা হতাশ কণ্ঠে বললেন–তাই চলুন সরকার মশাই, গ্রামটা তাহলে ঘুরেই দেখে আসি।
গ্রাম প্রদক্ষিণ করে দুপুরে খাবার সময় যোগেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দেখা হতেই এবারে মরিয়া হয়ে জলধরদা চাদরের তলা থেকে বইটা বার করেই একেবারে উৎসর্গের পাতাটা খুলে ধরে বলে উঠলেন—আমি তো যেতেই বসেছি—
জলধরদাকে থামিয়ে দিয়ে যোগেন্দ্রনারায়ণ বললেন–আপনি এর জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। আহারাদি করে বিশ্রাম করুন। আপনি যখন আজ বিকেলেই চলে যাবেন স্থির করেছেন, সরকারকে বলে দিয়েছি সে নিজে গিয়ে আপনাকে স্টেশনে তুলে দিয়ে আসবে। আপনি ওর জন্য কিছু ভাববেন না।
খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন জলধরদা। আশার আলোক যেন একটু দেখতে পেলেন। অতবড় মানুষ অথচ কী লজ্জা, কী বিনয়। একেবারে হাতে হাতে দিতে সংকোচ বোধ করছেন বলেই বোধ হয় সরকারের হাতে ইস্টিশনেই পাঠিয়ে দেবেন।
যথাসময়ে জলধরদা ইস্টিশনে এসে ঘন ঘন পায়চারি করছেন, ট্রেন আসতে তখনও মিনিট দশ দেরি। সরকার মশাই নীরবে একপাশে দাঁড়িয়ে। একটু রূঢ় কর্কশস্বরেই জলধরদা সরকার মশাইকে বললেন–রাজা কি সত্যিই কিছু আপনার হাতে দিয়ে পাঠান নি? কোন চেক বা চিঠিপত্র?
কই না। কিছুই তো দেন নি।
আমার কথা আপনার কাছে কিছু কি বলেছেন? উৎকণ্ঠিত চিত্তে জলধদা জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনার কোনরকম অসুবিধা হয়েছে কি না তাই শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আর তো কিছুই বলেন নি।
ট্রেন ততক্ষণে এসে গিয়েছে। ট্রেনের কামরায় বসেও জলধরদার স্বস্তি নেই। বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন আর সরকার মশাইকে বলছেন-দেখুন তো রাজবাড়ি থেকে কোন লোক ছুটতে ছুটতে আসছে কি না?
সরকার মশাই ভাল করে নিরীক্ষণ করে জানালেন কোন লোককেই এদিকে ছুটে আসতে দেখছেন না।
ট্রেন ছাড়ার হুইসিল বেজে উঠল।
এমন সময় দূরে দেখা গেল একজন লোক সাইকেল চালিয়ে স্টেশনের দিকে আসছে। আর যায় কোথা। জলধরদা চিৎকার করে বলে উঠলেন–সরকার মশাই, গার্ডকে শিগগির বলুন যেন গাড়ি এক্ষুনি ছেড়ে না দেয়। রাজবাড়ি থেকে আমার কাছে তোক আসছে। আপনি ছুটে গার্ডের কাছে চলে যান।
সাইকেল চালক ততক্ষণে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। সরকার মশাই পরামানিককে দেখেই চিনলেন, স্টেশনমাস্টারের দাড়ি কামাবার জন্যে আসছে। জলধরদাকে সে-কথা জানাতেই তিনি দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে এবং ক্রোধে ফেটে পড়লেন-পরামানিক কি আর সোনামানিক হতে পারত না? ইচ্ছে করলেই পারত। ইচ্ছে না থাকলে আর কোত্থেকে হবে। বুঝলেন সরকার মশাই, এই শরৎই যত নষ্টের মূল। সে-ই আমাকে জোর করে পাঠিয়েছিল। কলকাতায় ফিরেই ওর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে।