দীনেশবাবুর প্রতি মতিলালের শ্রদ্ধা চড়চড় করে বেশ কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেল।
সোমবার দিন যথাসময়ে দীনেশবাবু মেট্রপলিটান স্কুলে এসে হাজির। মিনিট পনের পরেই উড়িয়াবাহকরা একটি পালকি এনে স্কুলের গেটের সামনে রাখল। পালকির ভিতর থেকে সাদা উড়ানি গায়ে চটি পায়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বেরিয়ে এলেন। দীনেশবাবুকে দেখেই বললেন—চল তোকে হেড মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিই।
দীনেশবাবুকে সঙ্গে নিয়ে লাইব্রেরী রুমে গিয়েই হেড মাস্টারকে ডেকে পাঠালেন। গলাবদ্ধ কোট, কাঁধে পাটকরা চাদর, প্রৌঢ় বয়সী হেড মাস্টার মশাই আসতেই দীনেশবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন–তুমি একে প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণী পড়াতে দাও।
হেড মাস্টার মশাই দীনেশবাবুকে সঙ্গে করে ক্লাস রুমের দিকে নিয়ে যাবার সময় বললেন–আপনি দেখছি নিতান্তই ছেলেমানুষ। তা কোন সাবজেক্ট পড়াবেন?
দীনেশবাবু বললেন–ইংরেজী এবং ইতিহাস দুটোই আমি পড়াতে পারব।
স্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছেলেরাই সাধারণত তুখোড় হয়। হেড মাস্টার মশাই প্রথমেই দীনেশবাবুকে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে হাজির করে দিয়ে চলে এলেন। সৌন্দর্য সম্বন্ধে শেলী ও কীটস-এর তুলনামূলক আলোচনার পরই বৈষ্ণব কবিদের প্রেমতত্ত্বে এসে গেলেন, সঙ্গে ডাইনে-বাঁয়ে ইংরেজী কবিতা ও বৈষ্ণব পদাবলীর উদ্ধৃতি। ছেলেরা গেল হকচকিয়ে। পড়া শেষ করে দীনেশবাবু ছাত্রদের বললেন—তোমাদের পড়া দেখছি খুব কমই হয়েছে। পরীক্ষা নিকটবর্তী, কি করে সবটা শেষ করবে? যিনি ইংরেজী পড়ান তিনি তো তোমাদের পড়া কিছুই এগিয়ে দেন নি দেখতে পাচ্ছি।
দীনেশবাবু হয়ত ভেবেছিলেন পূর্ববর্তী মাস্টারের পাঠন-পদ্ধতি সম্বন্ধে ছাত্রদের মনে অনাস্থা ঢুকিয়ে দিতে পারলে কাজ হাসিল হবে। পড়ানো শেষ করে ক্লাস-রুম থেকে বার হতে গিয়েই দেখেন দরজার পাশে হেড মাস্টার ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে পড়ানো শুনছিলেন এবং উনি জানতেন না যে, ওই শ্রেণীর ছাত্রদের এতদিন ইংরেজী পড়িয়ে এসেছেন হেডমাস্টার স্বয়ং। পরের ঘণ্টায় দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রদের ইতিহাস পড়ালেন, নির্বিঘ্নে ফাঁড়া কেটে গেল। ভিতরে ভিতরে অনুসন্ধান করে যখন জানতে পারলেন উভয় শ্রেণীর ছাত্ররা ওঁর পড়ানোতে খুশী, নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি গেলেন।
পরের দিন মঙ্গলবার খুব গর্বের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে যেতেই বিদ্যাসাগর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বার করে দেখালেন, তাতে হেডমাস্টারের মন্তব্য লেখা আছে-প্রথম শ্রেণীর ছাত্ররা খুশী হয় নাই। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্ররা ভালই বলিয়াছে।
দীনেশবাবুর মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। একে ঢাকার বাঙাল, তার উপরে অল্প বয়েস। রাগলে রক্ষে নেই। বিদ্যাসাগরের মত সম্মানীয় ব্যক্তির সামনেই বিশুদ্ধ দ্যাশের ভাষায় হেডমাস্টারের বিরুদ্ধে যা-ইচ্ছে তাই বলে গেলেন। শেষে দরজার আড্ডালে দাঁড়িয়ে ওঁর মন্তব্য চুরি করে শোনার কথাও সবিস্তারে জানিয়ে বললেন–হডমাস্টর আমার উপরে চেইত্যা গিয়া এই রিপুর্ট দিছে।
বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র বিরক্ত না হয়ে বললেন–তোর ভিতরে দেখছি তেজ আছে। অন্তত একটা ক্লাসের ছাত্রদের যখন খুশী করেছিস তখন তুই পারবি। বাঙাল মাস্টার পেলে তো ছেলেরা তাকে লাড্ডর মত ব্যবহার করে। যা হোক আমি তোকে যোগ্য বলেই মনে করছি। তবে কি জানিস, তোর আগে পাঁচ ছয় জন যোগ্যতা দেখিয়েছেন, এই দেখ তাদের নাম। এরা কাজ পেলে তারপর তোর পালা। আর দেড় দুই মাস পরে আমি তোকে নিতে পারব। তুই মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করিস।
দীনেশবাবু, এ-কথায় খুশী হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। বললেন–আমার যে কুমিল্লার স্কুল খুলে যাবে, দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে। আপনি আমায় কাজ খালি হলে চিঠি দেবেন।
বিদ্যাসাগর ঘাড় নেড়ে বললেন–সে হবে না। তোর এখানেই থাকতে হবে। কাজ খালি হলে চিঠি লিখে অনাবার মত সবুর সইবে না। কে কোথা দিয়ে ঢুকে পড়বে। এখানে চাকরি প্রার্থীর অভাব নেই। কুমিল্লার চাকরি ইস্তফা দিয়ে যদি কলকাতায় থাকতে পারিস তবে কথা দিচ্ছি দুই মাসের মধ্যেই চাকরি পাবি।
বিদ্যাসাগর যে এক কথার মানুষ দীনেশবাবুর তা জানা ছিল না বলেই তার কথায় আস্থা রাখতে পারলেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যে চাকরি ইস্তফা দেওয়াটা সমীচীন মনে না হওয়ায় তিনি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন।
কলকাতায় থেকে সাহিত্যিক হবার প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেও নিরুদ্যম হন নি। এবার দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় অগ্রসর হওয়া যাক। অর্থাৎ এবার সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। যে-সে সম্পাদক নয়, একেবারে বঙ্গদর্শনের সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র।
বঙ্গদর্শন তখন বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা। বঙ্কিমবাবুর নিজের লেখা উপন্যাস ও প্রবন্ধাদি প্রতি সংখ্যাতেই প্রকাশিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে তখনকার ইংরেজী শিক্ষিত বহু বিদগ্ধ ব্যক্তিকে তিনি বাংলা ভাষায় প্রবন্ধাদি লেখায় উৎসাহিত করেন। বঙ্গদর্শনকে ঘিরে তখন একটি সাহিত্যগোষ্ঠী আপনা থেকেই গড়ে ওঠে। বঙ্গদর্শনে তখন একটি লেখা প্রকাশ করতে পারলেই লেখক রাতারাতি সাহিত্যিক-খ্যাতি লাভ করতেন।
মামাতো ভাই মতিলালকে প্রস্তাবটা দিতেই সে লাফিয়ে উঠল। প্রাত:–স্মরণীয় বিদ্যাসাগরকে দেখেছে, এবার দেখবে বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। মতিলাল বললে—তা হলে কাল সকালে চল।