নস্যি নেওয়ার পর্ব সমাধা হল, ইতিমধ্যে ছোকরা অমর চা আর পান যারযার সামনে রেখে ঘরের কোণের ছোট্ট টেবিলে স্তুপীকৃত গল্প কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলি উৎকর্ণ হয়ে ফাইলবন্দী করতে বসে গেল।
চায়ের কাপে চুমুক মেরে গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—ঘটনাটা ঘটেছিল বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-লেখক দীনেশচন্দ্র সেনকে নিয়ে। দীনেশ বাবু ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করে কুমিল্লাতে ভিক্টোরিয়া স্কুলে চাকরি নিয়েছেন, আর শহরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পুথি সংগ্রহ করেছেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বৈষ্ণব সাহিত্য গুলে খেয়েছেন, চণ্ডীদাস আর বিদ্যাপতি ওঁর নখাগ্রে। ওদিকে ইংরেজী ক্লাসিক সাহিত্যের দান্তে, হোমর, শেক্সপীয়রসৃষ্ট চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লিখে ফেলেছেন খাতার পর খাতা। লিখে তো চলেছেন, এখন সে-লেখা প্রকাশের কি উপায়। দীনেশবাবু ভালো করেই জানতেন তখনকার বাংলা সাহিত্যে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর ডেপুটি কালেক্টরের রাজত্ব। সেখানে ওঁর মতন সামান্য বেতনের এক ইস্কুল মাস্টারের লেখা প্রবন্ধ কলকাতার নামকরা পত্রিকাগুলি ছাপবে কেন। সুতরাং সাহিত্য করতে গেলে এবং সাহিত্যিক খ্যাতি পেতে হলে পূর্ববঙ্গের মফস্বল শহরে পড়ে থাকলে চলবে না, কলকাতায় গ্যাট হয়ে বসা চাই।
মামাতো ভাই মতিলালকে ডেকে বললে-দ্যাখ মতিলাল, আমি ভাবছি সামনের গরমের ছুটিতে এক মাসের জন্য কলকাতায় যাব।
দীনেশবাবুর যে-কোন প্রস্তাবেই মতিলাল উৎসাহিত। নিজে লেখাপড়া খুব বেশি কিছু করে নি বলে দীনেশবাবুর পাণ্ডিত্যের উপর ওর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। দীনেশবাবুর মুখে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সম্বন্ধে বাল্যকাল থেকেই বড় বড় কথা শুনে এসেছে; তাই ওর ধারণা-চান্স পেলে ওর ভাই সাহিত্যে মাইকেল-বঙ্কিমকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, পাণ্ডিত্যে বিদ্যাসাগরকেও। মতিলাল উৎসাহিত হয়ে বললে—কলকাতায় যাবি, খুব ভাল কথা। কিন্তু হঠাৎ কলকাতায় কেন?
কলকাতায় না গেলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। এখান থেকে ভাল ভাল লেখা পাঠাঁইফেরত আসে। কলকাতার সম্পাদকরা বাঙালদের উপর বড় চটা। আমলই দিতে চায় না।
মতিলাল ক্ষেপে গেল। বললে—কি বললি? চল, আমিও যাব তোর সঙ্গে।
দুই ভাই মিলে অনেক পরামর্শর পর স্থির হল, প্রথমে দীনেশবাবু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করবেন কলকাতায় একটা চাকরির জন্যে। কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে না বসতে পারলে লেখক হবেন কি করে। এক মাসের ছুটিতে পদ্মাপার হয়ে সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করে চলে এলেই আউট অব সাইট, আউট অব, মাইণ্ড। লেগে থাকতে হবে ছিনে-জোকের মত। কুমিল্লায় চাকরি করে তো আর সে সম্ভব নয়।
১৮৯১ সালের কথা। জ্যৈষ্ঠ মাস। দীনেশবাবু মামাতো ভাই মতিলালকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেই এক শনিবার সকালে প্রথমেই গেলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে। বিদ্যাসাগর তখন থাকতেন বাদুড়বাগানে। সে-বাড়ির দোতলার মাঝের একটা ঘরে চারিদিকে বই-ভর্তি আলমারি। তারই মাঝে একটা টেবিল, তার পাশে খানকতক চেয়ার পাতা। বিদ্যাসাগর একটি চেয়ারে বসে মাথা গুঁজে কি কাগজপত্র দেখছিলেন। দীনেশবাবু নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বিদ্যাসাগরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতেই সন্ত্রস্ত হয়ে পা সরিয়ে নিলেন। মনে হল পা ছুঁয়ে প্রণাম করাটা ওঁর পছন্দ নয়। দীনেশবাবু তখন যুবক, চেহারার মধ্যে একটা ছেলেমানুষি ভাব। দীনেশবাবুর দিকে তাকিয়েই বিদ্যাসাগর বললেন–কি চাস?
আজ্ঞে আপনার পায়ের ধূলো নিতে এসেছিলাম।
উহুঁ, বিশ্বাস হল না। মতলব কিছু-একটা আছে, বলেই ফেল।
প্রথম সাক্ষাতেই তুই সম্বোধনে দিনেশবাবু পুলকিত হয়ে উঠেছিলেন। অত বড় বিরাট ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মহাপুরুষ, অথচ কত সহজেই মানুষকে আপনার করে নিতে পারেন। সুতরাং উদ্দেশ্যটা খোলাখুলি বলতে আর সংকোচ রইল না। ইংরেজী অনাসসহ পাশ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা, কলকাতা আসার উদ্দেশ্য, একে একে সবিস্তারে জানানোর পর বললেন–আপনার স্কুলে আমাকে একটা চাকরি দিতেই হবে।
বাড়ি কোথায়?
আজ্ঞে, ঢাকা জেলায়।
তাই তো, তুই যে ঢাকার বাঙাল তা তো তোর কথার টানেই বুঝতে পেরেছি। এখানকার ছাত্র তোর টি জেলার ভিক্টোরিয়া স্কুলের ছাত্র নয় যে, তুই অনার পাশ, তা-ও ইংরিজীতে, শুনলে বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে পড়বে।
আপনি একবার পড়াবার চান্স দিয়েই দেখুন না স্যার।
এখানে বড় বড় ওস্তাদ শিক্ষকেরা ঘায়েল হয়ে যায়, ক্লাস সামলে উঠতে পারে না। তুই একে বাঙাল, তায় চেহারায় ছেলেমানুষ। তোকে তো একদিনে পাগল করে ছাড়বে।
দীনেশবাবুর তখন গো চেপে গিয়েছে। বললেন—আমাকে ক্লাস করতে দিয়েই দেখুন না। আর আমিও দেখতে চাই আপনার স্কুলের ছেলেরা বাঙালকে ঘায়েল করতে পারে কি না।
উত্তর শুনে বিদ্যাসাগর খুশী হয়েই বললেন–তোর তো বেশ সাহস আছে দেখছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না তুই পারবি। ও বাঙালের কর্ম নয়। যা হোক, তুই যখন চাচ্ছিস সোমবার দিন বেলা ১১টার সময় মেট্রপলিটান স্কুলে যাস। আমি সেই সময় যাব এবং তোকে ক্লাসে পড়াতে দেব।
বিদ্যাসাগরের বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়েই মতিলাল দুই চোখ বিস্ফারিত করে বললে—অতবড় লোকের সঙ্গে তুই সমানে পাল্লা দিয়ে কথা বলে গেলি, ভয়ে বুক কাঁপছিল না?
দীনেশবাবু বললেন—আরে আমরা হচ্ছি পদ্মাপারের লোক। ও-সব খাল, নদী, সাগর, মহাসাগর দেখে ভয় পেলে চলবে কেন।