লক্ষ্য করলাম যুবকটির মুখের সেই দরবিগলিত হাসি ক্রমশ মিলিয়ে গিয়ে বিমর্ষ ভাব দেখা দিল। কম্পিত হস্তে শার্টের বুকপকেট থেকে একটি ভাজ করা কাগজ বার করে বললে– আপনাকেই দেখতে এসেছিলাম, কিন্তু খালি হাতে আসি কি করে। তাই একটা কবিতা লিখে এনেছি।
এবার আমার হাসবার পালা। নিঃস্বার্থ ভক্তির এমন পরাকাষ্ঠা এর আগে কখনও দেখি নি। আগন্তুকের প্রতি বিরূপ মনোভাবের জন্য যে গ্লানিতে এতক্ষণ পীড়িত হচ্ছিলাম, এক নিমেষে তা কেটে গেল। উল্লসিত হয়ে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম—কবিতা এনেছেন তা এতক্ষণ বলেন নি কেন?
বিনয়ের সঙ্গে যুবকটি বললে-ওটা তো উপলক্ষ, তাই বার করতে সংকোচ বোধ করছিলাম। কবিতা আমি অনেকদিন থেকেই লিখছি, অনেক কবিতাই লিখেছি। সে-সব খাতা চিরিমিরিতেই রেখে এসেছি। আজ আপনাকে দেখতে আসবার আগে একটা আইডিয়া মাথায় এল, লিখে নিয়ে এলাম।
আড়চোখে গাল্পিক-সাহিত্যিকের দিকে তাকিয়ে দেখি মুখ সম্পূর্ণ পত্রিকার খোলা পাতায় আবৃত, শুধু ভুড়িটা ঈষৎ দুলছে। একটা উদগত হাসি চাপবার কী করুণ প্রয়াস। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন বিশুদা। চোখ বড় করে কি একটা বলতে গিয়েই অপরিচিত যুবককে দেখে থেমে গেলেন। হারিসন রোড ও চিংপুরের মোড়ে ষাঁড়ের লড়াই বা পকেটমারকে নিয়ে মারপিট, এই ধরনের কিছু একটা গল্প রাস্তায় কেঁদে এসেছিলেন, বলা হল না। খালি-চেয়ারটায় হতাশ হয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন। একটু পরেই এলেন সব্যসাচী লেখক, তরুণ কবি, ইনস্যুরেন্স-এর কেষ্টবিষ্ট, অফিসার।
ঘর জমজমাট। যুবকটি এত লোকসমাগমে হকচকিয়ে গেল। এতক্ষণে বোধ হয় বুঝতে পারল এবার উঠে পড়তেই হয়। চেয়ার থেকে উঠে নমস্কার জানিয়ে বললে
আপনার হাতে দিয়ে গেলাম, দেখবেন।
আমি বললাম—সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার হাতে যখন দিয়েছেন, গতি একটা কিছু হবেই।
আমার কথায় বিশেষ ভরসা পেল না যুবকটি। তাই আবার বললেদেখবেন, ফেরত যেন না আসে।
কথায় কথা বেড়েই চলবে এই আশঙ্কায় খোলাখুলি বললাম—না, ওকাজ আমরা কখনই করি না, বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে। এটা ধরেই নিই যে কবিতার নকল রেখে সবাই পাঠায়।
তা হলে জানব কি করে?
তিন মাস অপেক্ষা করবেন। যদি মনোনীত হয়, ওই সময়ের মধ্যে সেই সংবাদবহনকারী চিঠি যাবে আপনার কাছে। আর যদি চিঠি না পান
তা হলে
–তা হলে কী।
—আবার আরেকটা পাঠাবেন।–ও বুঝেছি। নমস্কার।
হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল যুবকটি। আগমনীর হাসি বিদায়কালে বিষাদে রূপান্তরিত। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। কি করে এই যুবককে বোঝাই যে, প্রতিদিন দপ্তরে কবিতার সংখ্যা আসে সর্বাধিক। সেইজন্যেই নির্বাচনে নির্মম না হয়ে উপায় নেই।
আমাকে দেখতে আসার নাম করে কবিতা দিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আদ্যোপান্ত রসিয়ে গাল্পিক সাহিত্যিক বৈঠকের বন্ধুদের কাছে বললেন। বিশুদা শুনে বললেন–কবিতা ছাপাতে হবে, তা ডাকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়। হাতে-হাতেই যখন দেবার ইচ্ছে তখন ভণিতা না করে সোজাসুজি দিয়ে চলে যাওয়াই তো উচিত। শনিবারের অজ্ঞাটাই দিলে মাটি
বৈঠকের তরুণ কবি এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। সমমর্মীর প্রতি বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বললে-আপনারা তো কেউ কবিতা লেখেন না, লিখলে বুঝতেন ওর মানসিক অবস্থাটা। নতুন লেখকমাত্ৰই সম্পাদকের দপ্তরটাকে মনে করে একটা বাঘের খাঁচা। আমার কথাই বলছি। আমি যখন প্রথম কবিতা নিয়ে এই দপ্তরে পদার্পণ করি, তখন হৃৎপিণ্ডটি ধড়াস ধড়াস করেছে, পেটের ভিতর যেন একেবারে ফাঁকা। কবিতাটি হাতে তুলে দিয়ে চুপ করে বসে থাকতাম ফাসির আসামীর মত। বিচারকের রায়ের উপর জীবনমরণ নির্ভর করছে। তখন বাধ্য হয়ে সম্পাদককে ইম্প্রেস করবার জন্য বলতাম-নরেনদা কি এসেছিলেন? গল্প-লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র যে আমার অগ্রজপ্রতিম এইটুকু জানান দিয়ে সম্পাদকের নেক নজরে পড়ার ক্ষীণ প্রয়াস। অর্থাৎ সম্পাদকের সবিশেষ পরিচিত বন্ধু গল্পলেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্রর সঙ্গে আমারও যে দাদাভাই সম্পর্ক, সেটুকু জানান দেওয়া!
বিশুদা বললেন—সেই জন্যেই চিরিমিরির যুবক-কবি সম্পাদককে ইম্প্রেস করবার চেষ্টায় ঘরে ঢুকে বলেছিল—আপনাকে দেখতেই এসেছি।
সব্যসাচী লেখক এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। তরুণ কবির দিকে তাকিয়ে টিপ্পনী কাটলেন-গ্রেট পোয়েটস অ্যাক্ট অ্যালাইক।
আবার একটা ঝগড়ার সৃষ্টি হয় দেখে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরার জন্যে গাল্পিক-সাহিত্যিককে অভিযোগ জানিয়ে বললাম-আপনার কাণ্ডটাই বা কি রকম। পত্রিকার পাতায় মুখ আড়াল করে ভুড়ি দুলিয়ে হাসা কি উচিত হচ্ছিল?
গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—চিরিমিরির কবির কথায় হাসি পেলেও চেপে রেখেছিলাম ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের একটা বিখ্যাত গল্প মনে পড়ায় হাসিটা ছিপিথোলা সোডার বোতলের মত ভুসভুসিয়ে উপরের দিকে ঠেলে উঠতে চাইছিল বলেই এই বিভ্রাট।
আর পায় কে বিশুদাকে। একটা রসালো গল্পের আভাস পেয়ে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল—কোথায় চা, কোথায় পান। সঙ্গে সঙ্গে গাল্পিক-সাহিত্যিককে সাবধান করে দিয়ে বললেন–নস্যি-টস্যি যদি আনাতে হয় এইবেলা আনিয়ে faali
পকেট থেকে নস্যির কৌটো বার করে গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—সে ভয় নেই, কৌটা আজ ভর্তি।
সব্যসাচী লেখক বললেন—তাহলে এই বেলা নাক ভতি নস্যি নিয়ে নিন। পরে গল্প থামিয়ে নস্যি নেওয়া কিন্তু চলবে না।