জলধরদা বলেই চললেন-তুমি ভাবছ নিজে খরচ করে কেন এ-বই ছাপলাম। কিন্তু এ-ছাড়া আর উপায় কী ছিল। প্রকাশকরা আমার বই নিতে চায় না, বলে কিনা আমার বইয়ের বিক্রি নেই। আমার আগের যেসব বই প্রকাশকদের কাছে আছে তার বাবদ কি পাওনা হয়েছে তার কোন হিসেব-পত্তর নেই। অন্তত অধিকাংশর কাছে হিসেব চাইতে গিয়ে আমার বই বিক্রি হয় না এই কথা শুনে লজ্জায় ফিরে এসেছি। তাই ভাবলাম আমার জীবনের এই শেষ উপন্যাস আমার যথাসর্বস্ব দিয়ে নিজের খরচেই প্রকাশ করব। কিন্তু এখন দেখছি তরী তীরের কাছে এসেই বুঝি ভেবে ডোবে।
এই জন্যে আপনার এত দুশ্চিন্তা? কিছু ভাববেন না। আমি আপনাকে সোজা উপায় বাতলে দিচ্ছি। কথাটা শরৎচন্দ্র বললেন বেশ একটু জোরে সঙ্গেই, যাতে জলধরদার মনের বোঝা নিমেষেই নেমে যায়। সত্যি সত্যি হলও তাই। ক্ষীণ আশার আলোক সঞ্চারে জলধরদার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
টেবিলের উপর থেকে উপন্যাসের ছাপা ফর্মাগুলি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে শরৎচন্দ্র বললেন–টাইটেল পেজ তো ছাপা হয় নি দেখছি। বইটা উৎসর্গ কাকে করবেন কিছু ভেবেছেন কি?
জলধরদার মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বললেন—ঠিক করেছি বইটা আমার প্রথমা পত্নীকেই উৎসর্গ করব—যিনি ছিলেন আমার প্রথম যৌবনের সাহিত্য প্রেরণার একমাত্র উৎস।
শরৎচন্দ্র মাথা চুলকে বললেন—প্রথমা পত্নীকে আপনি যে প্রাণাধিক ভালবাসতেন এই বৃদ্ধবয়সে সে-কথা দুনিয়াসুদ্ধ লোককে জানিয়ে আর লাভ কি। তাছাড়া তিনিও তো আর স্বর্গ থেকে নেমে এসে আপনার বই প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে যাকে উৎসর্গ করলে কাজ হবে তার কথাই ভাবুন।
এতক্ষণে জলধরদা যেন একটু আশার আলো দেখলেন। বললেন–তুমিই বল না কাকে উৎসর্গ করা যায়।
কেন লালগোলার রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় তো আছেন। একেবারে সাক্ষাৎ গৌরী সেন। তাঁর নামে উৎসর্গ করে সশরীরে বইটা তার হাতে তুলে দিন, দু-চার হাজার তো নির্ঘাত এসে যাবে।
শিশুর মত একগাল সরল হাসি হেসে জলধরদা বললেন—এই জন্যই তো তামাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম শরৎ। তুমি ছাড়া এসব বুদ্ধি আর কার মাথায় খুলত বল? তোমার পরামর্শ তো ভালই বোধ করছি, তবু এর মধ্যে একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে শরৎদা বলে উঠলেন—সে কথাও আমি যে ভাবি নি তা মনে করবেন না। উৎসর্গ করা সত্ত্বেও যদি টাকাটা না পান তাহলে একুল ওকুল দুকূল যাবে। এই তো আপনার আশঙ্কা?
ঠিকই বলেছ। জাতও দেব পেটও ভরবে না এরকমটা যেন না হয়।
শরৎচন্দ্র বললেন–তাহলে এক কাজ করুন। উৎসর্গ পত্রটি এখন আর ছেপে কাজ নেই। ওই পাতাটা কম্পোজ করিয়ে ভাল করে একটা প্রুফ টানিয়ে ছাপা ফর্মার সঙ্গে জুড়ে দিলেই হবে। সুতরাং আর কালক্ষেপ না করে দু-চার দিনের মধ্যেই লালগোলা চলে যান, যাবার আগে একটা চিঠি দিয়ে আপনার যাবার কারণটা না জানিয়ে শুধু খবরটা জানিয়ে রাখবেন।
শরৎচন্দ্র তো মোক্ষম পরামর্শ দিয়ে চলে এলেন।
তিন-চারদিন পর জলধদা শিয়ালদায় দুপুরের লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চেপে বসলেন। সন্ধ্যার সময় ইস্টিশনে লালগোলার সরকার মশাই এসে উপস্থিত। যথারীতি সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে তিনি জলধরদাকে নিয়ে গেলেন রাজবাড়িতে, শুভকাজটা সর্বাগ্রে সেরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াই ছিল জলধরদার ইচ্ছে। কিন্তু সরকার মশাই জলধরদাকে নিয়ে তুললেন অতিথিশালায়। জলযোগের ভূরি আয়োজন ছিল। কিন্তু জলধরদার উৎকণ্ঠিত চিত্ত রাজসন্দর্শনের জন্য অস্থির। তিনি প্রশ্ন করলেন-রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে কখন সাক্ষাৎ হতে পারে?
সরকার মশাই বিনয়ের অবতার। করজোড়ে নিবেদন করলেনপথভ্রমণে আজ আপনি ক্লান্ত, জলযোগাদি সেরে বিশ্রাম করুন। আপনার সেবার যাতে কোনরকম ত্রুটি না হয় সে কথা রাজা বারবার করে আমাকে বলে দিয়েছেন আর বলেছেন, রাত্রে আহারের সময় আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। ততক্ষণ নদীর ধারটা একবার আপনাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসতে বলেছেন, অবশ্য শারীরিক ক্লেশ যদি বোধ না করেন।
জলধরদা বললেন–বিলক্ষণ। লালগোলায় আমি আগে কখনও আসি নি। দেশটা ভাল করে দেখে যাওয়াই তো আমার অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এদেশের মহানুভব বাজার সাক্ষাৎ পরিচয় লাভ করা।
সরকার মশাই দুই হাত কচলে বললেন—সে তো নিশ্চয়, রাজাও আপনার মত দেশবরেণ্য সাহিত্যিকের দর্শনলাভের জন্য উৎসুক হয়ে আছেন। তা ছাড়া তিনি জানতে চেয়েছেন রাতে আপনার আহারাদির কি রকম ব্যবস্থা করা হবে।
জলধরদা বললেন—জলযোগের যা বিরাট আয়োজন করেছেন রাত্রে আর কিছু খেতে পারব বলে তো মনেই হয় না। তাছাড়া রাত্রে আমি খাই যৎসামান্যই। বিশেষ কিছু করবেন না-খান কুড়ি খাঁটি গব্যঘৃতে ভাজা লুচি, তার সঙ্গে কিছু মাংস। ভাজাভুজি দু-চার রকম করলেও করতে পারেন। আলু-ফুলকপি দিয়ে একটা নিরামিষ তরকারি। এখানকার গলদা চিংড়ি শুনেছি খুব ভাল। চিংড়ির একটা কালিয়া গরম-গরম লুচি দিয়ে মন্দ লাগবে না, তার সঙ্গে মুখ মারবার জন্যে আনারসের চাটনি থাকলেও থাকতে পারে। সবশেষে একটি ঘন দুধ, ক্ষীর বললেও বলতে পারেন। খাওয়ার শেষে একটা কিছু মিষ্টি খাওয়া আমার বহুদিনের বদভ্যাস। সঙ্গে মর্তমান কলা একটা দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু আমার বিশেষ অনুরোধ বেশী কিছু আয়োজন করবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন-বয়স হয়েছে, তাই রাত্রির খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিয়েছি। নইলে ঘুম হয় না, হজমেরও কষ্ট হয়।