আমাদের আড্ডায় একজন সাত্ত্বিক সাহিত্যিক আছেন, যিনি যাবতীয় পানদোষ থেকে মুক্ত। সুযোগ পেয়ে বলে উঠলেন—নিন, এবার ঠ্যালা বুঝুন। পইপই করে আপনাদের বারণ করেছিলাম অত সিগরেট খাবেন না, গলায় ফুসফুসে ক্যানসার হবে, একেবারে দুরারোগ্য রোগ। তা নয়, কারখানার চিমনির মত অনবরত মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়া আর ঘর দোর মেঝে চায়ের কাপ সিগারেটের টুকরোয় তছনছ করা। ঠিক হয়েছে। ওহে ছোকরা, যাও তো পাঁচ ছাইদানি চা এনে দাও বাবুদের। পয়সা না হয় আমিই দেব।
আমরা তো সবাই অবাক। বলল কি না-পয়সা আমিই দেব। জীবনে আজ বোধ হয় প্রথম ওঁর মুখে এই কথা শুনলাম। এমন কি চায়ের ছোকরাটাও যেতে-যেতে কথাটা শুনে যেন হকচকিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ছোকরা দিনের পর দিন এ-ঘরে চা দিয়ে যায়, সুতরাং আড্ডাধারী প্রতিটি ব্যক্তিকে সে ভাল করেই চেনে জানে। পুজোর সময় বকশিশ দিতে হবে এই ভয়ে যে লেখক পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পর জন্য পত্রিকা বা টাকা নিতে আসে না, বলেডাকে পাঠিয়ে দিন, কাজের চাপে সময় করে উঠতে পারছি না, এ-হেন ব্যক্তি—তিনি এক সাহেব কোম্পানীতে মোটা চাকরি করেন, কলকাতায় তিনতলা যার বাড়ি তা সত্ত্বেও যার কাছে ওয়ান্ পাইস ফাদার-মাদার, সে দেবে চায়ের দাম?
আমাদের সব্যসাচী লেখক বললেন–ওঁর কথা আর বলবেন না। আরে মশাই সেদিন ওঁর এক প্রকাশকের অফিসে রয়ালটি বাবদ মোটা টাকার চেক আদায় করেছেন। ওঁর অনেকগুলো উপন্যাস ওখান থেকে বেরিয়েছে কিনা। কর্মচারীরা ওঁকে এসে ধরলেন কিছু মিষ্টি খাওয়াতে; ওখানে যে সব লেখকদের বইয়ের মোটামুটি ভাল বিক্রি তারা কর্মচারীদের পাঁচদশ টাকা দিয়ে থাকেন মিষ্টি খাবার জন্যে। কি বলব মশাই, বুক পকেট থেকে অতি কষ্টে একখানা দুটাকার নোট বার করে দিলেন, যেন নিজের কলজেটা উপড়ে দিচ্ছেন, এ রকম মুখের ভাব।
আপনি কি করে জানলেন? আপনি তো আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একটু রাগতস্বরে বললেন–সাত্ত্বিক সাহিত্যিক।
উপস্থিত থাকতে হবে কেন। প্রকাশকের সেই প্রুফ-রীডার, যে মাঝে মামা চোখের ইশারায় আমাকেও সারেণ্ডার করতে বললেন, আমিও বার করলাম। দাদামশায়ের তো দেখে চক্ষু স্থির।
আড্ডার গাল্পিক বন্ধুটি এতক্ষণে মুখ খুললেন। বললেন–বা-ব্বা! একখানা মামা বটে। তা আপনার দাদামশাই সত্যিই কিছু বললেন না?
বলবেন আর কি। পরের মাসেই মামাকে পাঠিয়ে দিলেন রাঁচী। রামকৃষ্ণ মিশনের একটা বিদ্যাপীঠ আছে, যেখানে প্রথমেই ছাত্রদের মাথা মুড়িয়ে দেয়,
সেইখানে।
যাক, মামার তো সর্বনাশ যা হবার হল। আপনার কি গতি হল?
দাদামশায় বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন পরীক্ষার পরই আমাকে যেন কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়েও গেলেন। শুধু কলকাতা থেকে নয়, একেবারে ভারতবর্ষের বাইরে আমাকে চলে যেতে হল।
আমাদের সেই সব্যসাচী রসিক বন্ধুটি টিপ্পনী কেটে বললেন—ভারতবর্ষের বাইরে গিয়েছিলেন, ভালই করেছিলেন। ফিরে এলেন কেন? সাহিত্যিকদের এই ভিড়ে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্তত কমত।
০৩. আবার আপনাদের সেই গল্পতে
আবার আপনাদের সেই গল্পতে ফিরিয়ে নিয়ে আসি যে-গল্প দিয়ে সম্পাদকের বৈঠকে শুরু করেছিলাম। শরৎচন্দ্র জলধরদাকে নিয়ে একবার মারাত্মক রসিকতা করেছিলেন, যার ফলে বেশ কিছুকাল দুজনের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা শুনেছিলাম বৈঠকের সেই গাল্পিক সাহিত্যিকের মুখে। আমি শুধু পুনরাবৃত্তি করছি।
একদিন দুপুরে জলধরদা বিষণ্ণমুখে ভারতবর্ষ অফিসে চুপচাপ বসে আছেন। টেবিলের উপর তাঁর সদ্য লেখা উপন্যাস উৎসর ছাপা ফর্মার উপর সকরুণ দৃষ্টি নিবদ্ধ। এমন সময় শরৎচন্দ্র নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেই জলধরদার এমন মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। সভয়ে অথচ স্বভাবগত ফক্কড়ি করে জিজ্ঞাসা করলেন—
একি জলধরদা! কেন আজি হেরি তব মলিন বদন? কিবা প্রয়োজনে মাগিয়াছ–
রাগতস্বরে জলধরদা বললেন—দেখ শরৎ, সব সময় তোমার এই ঠাট্টা ইয়ার্কি ভাল লাগে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়। তোমায় ডেকে পাঠিয়েছিলাম কোথায় আমাকে একটা সৎপরামর্শ দেবে, তা নয় ঘরে ঢুকেই থ্যাটারি শুরু করে দিলে।
জলধরদার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের পরিচয় অনেক দিনের। যেদিন থেকে জলধরদা ভারতবর্ষের সম্পাদনার ভার নিলেন সেদিন থেকেই শরৎচন্দ্র এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক। লেখক-সম্পাদক পরিচয় ক্রমশ নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়ে এতদিনে মধুর ইয়ার্কির সম্পর্কে এসে দাঁড়িয়েছে। জলধরদাকে শরৎচন্দ্র বরাবরই অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করেন। শুধু বয়ঃজ্যেষ্ঠ বলেই নয়, সাহিত্যিক জলধর সেন শরৎচন্দ্রর অগ্রণী। তাছাড়া এই আত্মভোলা মানুষটির চারিত্রিক মাধুর্য সবসময়েই শরৎচন্দ্রকে আকৃষ্ট করেছে। শরৎচন্দ্র অনুমান করলেন নিশ্চয় সদ্যছাপা উপন্যাস নিয়েই জলধরদার এই দুশ্চিন্তা। ওঁর চোখের দৃষ্টিই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ-যেন অরক্ষণীয়া কন্যার প্রতি পিতার ব্যথাতুর দৃষ্টি।
জলধরদা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন—জানো শরৎ, এইটিই আমার শেষ উপন্যাস। আমার যা-কিছু সঞ্চয় ছিল সেই টাকা দিয়েই উপন্যাসটি ছাপলাম। এখনও প্রেস-কে কিছু টাকা দেওয়া বাকি কিন্তু বাইণ্ডার বলছে কিছু টাকা আগাম না পেলে ছাপাখানা থেকে আর ছাপা ফর্মা ও ডেলিভারি নেবে না। এখন কি করি বল তো?
শরৎচন্দ্র অবাক। এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের সামান্য সঞ্চয় এভাবে নিঃশেষ করলেন?