জলধরদা টেবিলের উপর ঝুকে পড়ে ডান কানের পিঠে হাত রেখে বললেন–
কি বললেন? শরীর? সঙ্গমে এসে পড়েছি। এখন মহাসমুদ্রে বিলীন হলেই হয়।
বুঝলাম, আমার প্রশ্ন শুনতে পান নি। তাই আরেকটু গলা চড়িয়ে আমার লেখার কুশল প্রশ্ন করলাম।
–লেখা? লেখা-টেখা সব এখন বন্ধ। বয়েস হয়েছে, চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। নতুন লেখায় আর হাত দিতে পারছি না।
বন্ধু বললেন–আপনারাই বলুন, এরপর গল্প সম্বন্ধে আর কি প্রশ্ন করা চলে? নতুন লেখকদের প্রতিষ্ঠা লাভের একমাত্র চাবিকাটি সহিষ্ণুতা। আমিও তাই আর তৃতীয়বার ট্রাই না করেই নমস্কার জানিয়ে বিদেয় হলাম। পরের মাসেই দেখি গল্পটি ছাপা হয়েছে।
সবাই সমস্বরে হেসে উঠলাম। জলধরদার ট্যাকটিক-এর বলিহারি। নতুন লেখকদের কেন গল্প অমনোনীত করেছেন এই প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পাবার এক মোক্ষম উপায়। মুড়ি-তেলেভাজা এসে গেছে, আমিই সর্বাগ্রে সক্রিয় হয়ে সৎকারে লেগে গেলাম। জোড়া টেবিলের পূর্বপ্রান্তে এতক্ষণ যে সাহিত্যিকবন্ধুটি নীরবে বসে এইসব খোশগল্প শুনে যাচ্ছিলেন তিনি একজন কবি, বয়সে আমাদের মধ্যে তরুণতম। এবার তিনি মুখ খুললেন।
-শুধু জলধরদাকে এই ট্যাকটিকসের জন্য দোষ দিলে চলবে কেন। এরকম ট্যাকটিকস্ আরও একজন সম্পাদককে এবং হালফিলের সম্পাদককে আমি নিতে দেখেছি।
সবিস্ময়ে আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকালাম। অর্থাৎ কে তিনি?
কবি বন্ধু বললেন–বেশী দিনের কথা নয়। তখন আমি দু-একটা কবিতা লিখলেও ছোট গল্পই বেশী লিখতাম। কোন একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদকের দপ্তরে একটি গল্প পাঠিয়ে দু মাস বাদে সম্পাদকের অফিসে খোঁজ নিতে গিয়েছি। সেই আমার প্রথম সম্পাদকের কাছে যাওয়া, তাই দুরুদুরু বক্ষে গল্পর কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি টেবিলের ওপরে কাগজের ঠোঙায় রাখা একগাদা পানের মধ্যে থেকে দুটি পান মুখে পুরলেন, পকেট থেকে জদার কৌটো বার করে এক খাবলা মুখে ফেলে সেই যে ধ্যানস্থ হয়ে জাবর কাটতে লাগলেন আর স্পীক-টি নট।
আবার জিজ্ঞাসা করলাম—আমার দুমাস আগের দেওয়া গল্পটা?
ধ্যানীবুদ্ধের মত দক্ষিণ হস্ত তুলে বরাভয়ের মুদ্রা দেখিয়েই আবার তিনি গালভরতি পান জর্দার রস উপভোগে মগ্ন হলেন। আবার প্রশ্ন, আবার সেই হস্ত প্রসারণ। ট্রামের মান্থলি টিকিট দেখালে কনভাকটার যেমন হাত তুলে আশীর্বাদের মুদ্রা দেখিয়ে জানায় ঠিক হ্যায়, এও তেমনি, ততক্ষণে আমার মেজাজ তিরিক্ষি। আমারও জেদ চেপে গেল, একটা কিছু উত্তর না নিয়ে ছাড়ছি নে। আবার বললাম, গল্পটার কি করলেন বলুন।
এবারে সম্পাদক মহাশয়ের ধ্যান ভাঙ্গল। বুঝলেন, এ ছোকরা সহজে নড়বার পাত্র নয়। অগত্যা চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, বারান্দায় গেলেন, পানের পিক ফেললেন, ঘরে এসে খানিকটা জল খেয়ে বললেন–
পিক্ সেই ফেললেনই। সবে দুমাস হয়েছে, আরও একমাস যাক তখন জানতে পারবেন।
বিনা বাক্য ব্যয়ে চলে এলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেই পত্রিকা অফিসের পিয়ন বাড়ির দরজায়। হাতে একটা খাম। আমার সেই গল্প আর তার সঙ্গে সম্পাদকের এক দীর্ঘ পত্র।
আমাদের মধ্যে একজন বললেন–সেই ছাপানো চিঠি তো? যাতে লেখা থাকে-রচনাটি অমনোনীত হওয়ায় দুঃখের সহিত ফেরত পাঠাঁইতে হইল। আশাকরি ভবিষ্যতে আপনার সহানুভূতি হইতে বঞ্চিত হইব না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কবিবন্ধু বললেন–ঠিক তা নয় তবে তার কাছাকাছি। সম্পাদকের স্বহস্ত লিখিত সেই চিঠির মোদ্দা কথাটা হচ্ছে গল্প লেখা কস্মিনকালেও আমার দ্বারা হবে না। কবিতাতেই নাকি আমার স্বাভাবিক ফুতি তাই কবিতাই যেন আমি লিখি। তারপর আর কোনদিন গল্প লিখি নি।
গল্প শুরু করেছিলাম শরৎচন্দ্র ও জলধরদাকে নিয়ে। কিন্তু প্রস্তাবনা করতে গিয়ে কথায় কথায় কোথায় এসে পড়েছি। গল্পটা শুনেছিলাম সেদিনের আড্ডাতেই আমাদের এক কথা সাহিত্যিক বন্ধুর মুখে। শরৎচন্দ্র একবার জলধরদাকে কি রকম জব্দ করেছিলেন। আজ থাক। গল্পটা বারান্তরে আপনাদের শোনাব।
০২. শনিবারের বৈকালিক বৈঠক
শনিবারের বৈকালিক বৈঠক সেদিন জমজমাট। খোশ গল্পের যাবতীয় ইন্ধন উপস্থিত, শুধু উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছি আমাদের এই আডর প্রধান গাল্পিক সেই কথা-সাহিত্যিক বন্ধুটির, যিনি শরৎচন্দ্র আর জলধরদার কাহিনী আমাদের শোনাবেন বলে সুড়সুড়ি দিয়ে রেখেছিলেন।
এমন সময় শাল পাতা মোড় একটা ঠোঙা হাতে তিনি এসে উপস্থিত। সবাই বিস্মিত, ঠোঙায় আবার কী এল!
বন্ধুবর বললেন–বড়বাজারের মোড়ে নেমেই দেখি ফুটপাতের ধারে অয়েল-কেক, একেবারে গরমাগরম। অডিডার গল্পের সঙ্গে ভাল জমবে ভেবেই এক ঠোঙা নিয়ে এলাম।
অয়েল-কেক? সে আবার কি।
ও, সাহেবী ভাষায় বললাম বলে বুঝি অবাক হচ্ছেন। আমাদের আদি ও অকৃত্রিম তেলে ভাজা। এবার বুঝলেন তো? রাস্তার ধারে তোলা উনুনে ভাজছিল। আর জানেন তো? যত ধুলো পড়বে ততই তার আস্বাদ আর ততই তার রঙের খোলতাই।
আড্ডার আর এক বন্ধু যিনি রম্য রচনায়, গল্প-উপন্যাসে, কাব্য-কবিতায় সব্যসাচী অর্থাৎ যিনি সাহিত্যের বাজারে জ্যাক অব অল ট্রেডস তিনি যেমন শীর্ণদেহ তেমনি পেটরোগ। কথাবার্তায় শ্লেষ তার থাকবেই, কিন্তু আড্ডায় রসের যোগান দিতে তিনি অদ্বিতীয়। তিনি বললেন—
আপনার আনা অয়েল-কে দেখেই বুঝতে পারছি যে আপনার লেখা গল্প কেন পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।