চেয়ারে এলায়িত দেহটা ততক্ষণে খাড়া করে জলধরদা বললেন–তা আমার কি দোষ। ছাপবার জন্যে প্রেস-এ তো দিয়েছিলাম।
প্রেস-এ দিয়েছিলেন তা তো আমিও জানি। তবে ছাপা হল না কেন? গল্পের কোথাও অশ্লীলতা কিছুই তো ছিল না।
তা ছিল না, তবে ফুটকি ছিল, প্রেস-এ অতো ফুটকি নেই। হরিদাসকে বলে ফাউণ্ডিতে একপো ফুটকির অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এলেই ছাপা হবে।
শ্বেতশ্মশ্রুমণ্ডিত জলধরদার মুখাবয়বে আবার সেই তৃষ্ণভাব, নির্বিকার নিরাসক্ত। আগন্তুক ভদ্রলোক এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ঝিম মেরে গেলেন। কোথায় গেল সেই দাপট, কোথায় সেই আস্ফালন। মাজায় বাড়িখাওয়া কুকুরের মত কেঁউ-কেঁউ করে তিনি বললেন—ফুটকিগুলো কেটে দিলেই তো পারতেন।
জলধরদা যেন সমাধিস্থ অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বললেন, তোমাদের এই ফুটকি-রহস্যের আজও আমি কোন হদিস করতে পারলাম না। ওই ফুটকির মধ্যে কী যে অকথিত কথা থাকে তা তুমিই জানো আর জানে তোমার পাঠকরা। প্রিন্টার এসে গোল বাধায়, বলে ফুটকি নেই, ফুটকি চাই।।
আমার এই গল্পে এখানেই বাধা পড়ে গেল। আড়র এক বেরসিক বন্ধু আর অপেক্ষা করতে না পেরে বলে বসলেন-এ নিশ্চয় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়।
উত্তর দেবার আগেই সমস্বরে আর সবাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–আরে মশাই এ-যে সৌরীন মুখুজ্যে সে কি বলে দিতে হবে? বলে যান তারপর কি হল?
আমি দেখলাম প্রতিবাদ করা বৃথা। তাছাড়া আমার গল্প তো সেই লেখককে নিয়ে নয়, আমার গল্পের নায়ক সেই ছবি, তাও আবার শরৎচন্দ্রের। শরৎচন্দ্রের সেই অয়েল-কালার পোট্রেট-এর কি দশা, অথবা দুর্দশাই হল সেই কথাই বলছি।
টেবিলের উপর পড়ে থাকা শরৎচন্দ্রের উপর ফুটকি সাহিত্যিকের ততক্ষণে নজর পড়েছে। মুহুর্তের মধ্যে ছবিটা টেনে নিয়ে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন করলেন–এ কী জলধরদা, শেষে কি বুড়ো বয়সে চরিত্তির খোয়াবেন? এ-সব উগ্র আধুনিক আর্ট আপনার টেবিলে?
না হে, ওটা শরৎচন্দ্র। এই ছোকরা এনেছে ছাপবার জন্যে। আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সোজা করে ধরলে মনে হয় আকাশের সাদা মেঘ, উল্টো করে ধরলে আমাদের মেছুয়াবাজারের পাকা দাড়িওয়ালা বুড়ো কলিমুদ্দি দপ্তরীর চেহারাটা ভেসে ওঠে। শরৎচন্দ্র যে এর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছেন খুজে পেলাম না। তাছাড়া বুড়ো হয়েছি, চোখের দৃষ্টিও কমে এসেছে।
বলা বাহুল্য শরৎচন্দ্রের সাদা চুল এ-ছবির অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিল।
এর পরে আর আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সমীচীন নয়। যদিও এই ছবি প্রসঙ্গে দুই সাহিত্যিকের মন্তব্যে কৌতুকবোধ করছিলাম এবং এই রঙ্গমঞ্চে হরিদাসবাবুর আবির্ভাব হলে আরও কিছু নতুন মন্তব্য শোনাতে পারতাম। কিন্তু আর অপেক্ষা করা যায় না। এদিকে বেলা তখন বারোটা পার। স্নান-খাওয়া কিছুই হয় নি। বিকেল চারটার গাড়িতে আবার আমায় শান্তিনিকেতনে ফিরে যেতে হবে। সন্তর্পণে ছবিটা প্রবীণ সাহিত্যিকের হাত থেকে উদ্ধার করে খবরের কাগজ দিয়ে মুড়তে মুড়তে আর অধিককাল অপেক্ষা করার অসুবিধার কথা জানিয়ে বিদায় চাইলাম।
নিমেষে জলধরদার করুণাঘন দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ হল। সহানুভূতিমাখা কণ্ঠে বললেন—সে কী, সেই ভোরে রওনা হয়ে স্টেশন থেকে সোজা এসেছ, কই, সে কথা এতক্ষণ বলে নি কেন?
কথা বলতে বলতে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে কোটের এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে একটা আধুলি টেনে বার করেই বেয়ারাকে হাঁক দিলেন—যা দৌড়ে যা, কচুরি আর ভালো ভালো সন্দেশ নিয়ে আয়।
অতি কষ্টে নানা অজুহাত দেখিয়ে জলধরদাকে নিবৃত্ত করলাম। বুঝলাম আত অভুক্ত হতাশ চেহারাটা ওকে ব্যথা দিয়েছে। ছবিটা বগলদাবা করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই জলধরদা অনুনয়ের সুরে বললেন–কিছু খেয়েদেয়ে হরিদাসের জন্য আর একটু অপেক্ষা করে গেলে হত না? ও আজকালকার ছেলে, ছবিটা ওর হয়তো পছন্দ হত।
ইতিমধ্যে আগন্তুক সাহিত্যিক আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললেন–তুমি ত শান্তিনিকেতনের ছেলে। জলধরদার ইচ্ছে রোববাবুর নাম করে রামানন্দ চাটুজ্যেকে ধরে ছবিটি প্রবাসীতে ছেপে দাও। তবেই রগড় জমবে।
হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন জলধরদা। বয়েস হয়েছে, আক্কেল হল না? রসিকতারও তো একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে।
জলধরদার গর্জন শুনতে শুনতে আমি ততক্ষণে রাস্তায় নেমে পড়েছি।
আমার কথা শেষ হতেই একজন প্রশ্ন করলেন-ছবিটা কি শেষ পর্যন্ত আর ছাপাই হয় নি?
হয়েছিল বাতায়ন পত্রিকায়, শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর। ছবিটা তারিফও পেয়েছিল খুব।
গল্প বলতে বলতে কখন যে টেবিলের মুড়ি-নারকল সাবাড় হয়ে গেছে টেরও পাই নি। অক্ষেপ জানিয়ে বললাম-–জলধরদার কচুরি-সন্দেশ খাওয়া হল না আর সেই গল্প বলতে গিয়ে মুড়ি-নারকল থেকে বঞ্চিত হলাম।
ফল হল। আড্ডাধারী বন্ধুদের মধ্যে একজন সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা মুড়ি-তেলেভাজা তৎসহ আরেক প্রস্থ চায়ের জন্য বেয়ারার হাতে টাকা দিয়েই প্রশ্ন করলেন
আচ্ছা, জলধরদা যে কানে খুবই কম শুনতেন সে-কথা তো আপনি বললেন না?
অবাক হয়ে বললাম—কই আমি তো তার কোন পরিচয় পাই নি।
বন্ধুটি মৃদু হেসে বললেন—এখন বুঝতে পারছি লোক বিশেষে তিনি কানে কম শুনতেন। সেটাই ছিল তাঁর ট্যাকটিক। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই একথা বলছি।
সবাই উৎসুক হয়ে উঠলাম আরেকটি গল্পের গন্ধ পেয়ে। বন্ধুবর বললেন–
আমি তখন আশুতোষ কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, কলেজ মাগাজিনে একটা গল্প লিখে সুনাম হয়েছে। ক্লাসের বন্ধুরা উৎসাহ দিয়ে বললেনামকরা কাগজে তুই লেখ, নিশ্চয় ছাপা হবে। একদিন কলেজের পর সাইকেলটা নিয়ে সোজা গেলাম ভারতবর্ষ অফিসে জলধরদার কাছে। একটি গল্প দিয়েই চলে এলাম। একমাস যায়, দুমাস যায় তৃতীয় মাসও গেল। গল্পের আর কোন পাত্তা নেই। চতুর্থ মাসে আবার সাইকেলে করে ভারতবর্ষ অফিসে। জলধরদার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-চার মাস আগে একটা গল্প দিয়েছিলাম, সেটা কি আপনার মনোনীত হয় নি?