বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয়ে লিখে গেছেন-সদা সত্য কথা কহিবে। আদালতে সাক্ষীকে সাক্ষী দেবার আগে সত্য বই মিথ্যা বলিব না বলে শপথ নেবার রীতি আজও প্রচলিত আছে। স্বাধীন ভারত-রাষ্ট্রের প্রতীক ত্ৰিসিংহ মূর্তির সঙ্গে স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকে—সত্যমেব জয়তে। চারিদিকে এত সত্যের ছড়াছড়ির মধ্যে আমি অসত্য কাল্পনিক কাহিনী শোনাব এত দুঃসাহস আমার নেই। তবুও বলে রাখা ভাল আমি একটু কমবেশী ভেজালেরই ভক্ত।
কিছু খাদ না থাকলে সোনা যেমন উজ্জ্বল হয় না, কিছু ভেজাল না থাকলে আমাদের আজকের সমাজ-জীবনে লোকে দু-পয়সা করে খেতে পারত না। খাঁটি তেল-ঘির স্বাদ আজকের দিনে আমরা ভুলেই গেছি। আমি তাই এই যুগকে বলতে চাই ভেজালের যুগ। সুতরাং আমার এই কাহিনীর মধ্যে কিছু ভেজাল যদি থেকে থাকে তো আমি নাচার।
দিনলিপি রাখার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিল না। স্মৃতি ও শ্রুতির উপর নির্ভর করেই এ কাহিনী রচিত। স্মৃতির পটে কিছু ঘটনা ধরা ছিল, অনেক হারিয়ে গেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া ফাঁকগুলি ভরাবার জন্য কিছু ভেজালের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এ কাহিনীর পাঠকদের কাছে তাই আমার অনুরোধ, হাঁসের মত নীর থেকে ক্ষীরটুকু শুধু বেছে নেবেন, তাহলেই সত্যাসত্যের দ্বন্দ্ব ঘুচে যাবে। যাই হোক—
আমি যে গল্প বলতে যাচ্ছি তা নিছক গল্পই, বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল চরিত্রকে নিয়ে। একজন জলধরদা, সম্পাদক জলধর সেন। অপরজন শরৎচন্দ্র। সে গল্প এখন থাক, গল্পের ভূমিকাটি বলে নিই। বর্মণ স্ট্রীটে দেশ পত্রিকার দপ্তরটি ছিল একেবারে নিরিবিলি জায়গায়, নিত্য শনিবার সমবয়সী সাহিত্যিক বন্ধুরা সমবেত হতেন। জোড়া দেওয়া টেবিলের উপর খবরের কাগজ পেতে সের খানেক মুড়ি ঢেলে নারকলবাতাসা-ছোলা-চিনাবাদাম সহযোগে আড্ডা বসত, সঙ্গে চলত পত্রিকা দপ্তরের নিত্য অনুপান চা ও সিগারেট।
কথায় কথায় ভারতবর্ষ সম্পাদক জলধরদার প্রসঙ্গ উঠতেই আমার ছাত্রজীবনে তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বৃত্তান্ত বললাম।
আমি তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল হায়দ্রাবাদবাসী এক শিল্পীর সঙ্গে, নাম সুকুমার দেউস্কর। বিখ্যাত শিল্পী শশী হস-এর তিনি বংশধর। ইটালীতে কিছুকাল থেকে, সে-দেশের তেল রঙে প্রোট্রেট আঁকার যাবতীয় পদ্ধতিতে তিনি তখন সিদ্ধহস্ত।
রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলা সাহিত্যে মধ্যগগনের সূর্য, শরৎচন্দ্র নৈশগগনের একশ্চমোহস্তি।
শরৎচন্দ্রের জয়ন্তী উৎসব ঘটা করে করবার উদ্যোগ চলছে। শিল্পী বন্ধু সুকুমারদা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ভক্ত পাঠক, এই উপলক্ষে তিনি কাঠের উপর তেলরঙ দিয়ে শরৎচন্দ্রের একটি জবরদস্ত পোট্রেট একে আমায় বললেন–এই সময়ে কলকাতার কোনো পত্রিকায় ছবিটা ছেপে দাও।
মনে পড়ল ভারতবর্ষের কথা। শরৎচন্দ্র ভারতবর্ষের নিয়মিত লেখক, তাছাড়া সম্পাদক জলধর সেনের তিনি খুবই প্রিয়পাত্র। ছবিখানি হাতে করে সটান চলে এলাম কলকাতায়, একেবারে ভারতবর্ষের অফিসে।
এর আগে জলধরদাকে দূর থেকে শুধু চোখে দেখেছি, সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। একবার রবিবাসরের সভ্যদের রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আহ্বান করেছিলেন। সেই সময়ে বহু সাহিত্যিক সমাগম হয়েছিল, জলধরদাও এসেছিলেন।
ভারতবর্ষ অফিসে এসে সসঙ্কোচে ভয়ে ভয়ে জলধরদার কামরায় ঢুকলাম। প্রশান্ত মূর্তি জলধরদা অর্ধনিমীলিত চোখে ইশারায় সামনের চেয়ারটিতে বসতে বলেই জিজ্ঞাসা করলেন—অভিপ্রায়?
—শরৎবাবুর একটা রঙীন পোট্রেট এনেছি, একবার যদি দেখেন। খবরের কাগজের ভাঁজ খুলে ছবিটি তার হাতে তুলে দিলাম।
ছবিটি হাতে নেওয়া মাত্রই জলধরদার চোখ-মুখের সেই প্রশান্ত ভাব নিমেষে একটা বিরক্তিমাখা অপ্রসন্নতায় ভরে উঠল। দুহাতে ছবির দুটো ধার ধরে একবার চোখের কাছে নিয়ে আসেন, আবার দুই হাত সটান সামনের দিকে প্রসারিত করে দূরদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন। ভাবের অভিব্যক্তির আর কোন পরিবর্তন নেই। তার পরেই ছবিটাকে উল্টো করে ধরে কুঞ্চিত তন্ময়তায় কি যেন একটা খুঁজে বার করবার জন্যে উঠে পড়ে লাগলেন। তাঁর দুই হাতের কবজিগত ছবিটা ততক্ষণে আমার উৎকণ্ঠিত মনে পরিণত হয়েছেমুঠোর নিষ্পেষণে কণ্ঠাগতপ্রায়।
অবশেষে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব মুখে এনে ছবিটা টেবিলের উপর ধপাস করে ফেলে জলধরদা বললেন—
না হে, ও আমার কম্মো নয়। আনুক হরিদাস, এ-সব শান্তিনিকেতনী আট ও-ই বুঝবে ভালো।
ক্ষীণ কণ্ঠে সভয়ে আমি বললাম-আজ্ঞে না। এটা শান্তিনিকেতনী আর্ট নয়, কন্টিনেন্টাল আর্ট। একেবারে মডার্ন ইটালিয়ান স্কুল।
গর্জন করে উঠলেন জলধরদা।–এসব ইস্কুলের ছেলে ছোকরাদের ছবি তা আমার কাছে এনেছ কেন? মৌচাক শিশুসাথীতে গেলেই তো পারতে?
বুঝলাম প্রতিবাদ করা বৃথা। আসুন হরিদাসবাবু, অর্থাৎ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, ভারতবর্ষ পত্রিকার অন্যতম কর্তা। তার কাছেই নিবেদন পেশ করা যাবে। ততক্ষণে জলধরদা আবার সেই সৌম্য শান্ত মূতিতে ফিরে গেছেন, সেই অর্ধনিমীলিত চোখ। নির্বিকার, নিরাসক্ত।
চুপচাপ বসেই আছি, আরও কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানি না। আমারও জেদ চেপে গেছে, একটা কিছু না করে আর নড়ছি নে। আসুন হরিদাসবাবু।
এমন সময় ছড়ি হাতে দীর্ঘাঙ্গ এক প্রৌঢ় ঘরে ঢুকেই বোমাফাটার মত চিৎকার করে উঠলেন—এ কী জলধরদা, আপনি বলেছিলেন এ-মাসেই আমার গল্পটা ছাপা হবে কিন্তু পত্রিকায় তো গল্পটা দেখলাম না?