পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহটা গোঁসাইজী সেদিন এক ফুয়ে নিবিয়ে দিলেন। আজ চালশেধরা চল্লিশের পরপ্রান্তে এসে দেখছি আমার জীবনে গুরুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে। শুধু বাংলা পরীক্ষায় কেন, জীবনের সব পরীক্ষায় ফেল মেরে অবশেষে আজ যেখানে এসে পৌঁছেছি, সেখানে চারিদিকে এত আলো তবু আমি অন্ধকারে। লেখক আর হতে পারলাম না, যদিও লেখা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা আজ আমার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। বালক বয়সে যা-ছিল আমাদের নেশা, ভাগ্যচক্রের আবর্তনে আজ পেশায় পরিণত হয়েছে। কঙ্করদা আজ ইংরেজী দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম কর্মী আর আমি আজ বিশ বছর যাবৎ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর গুরুবাক্যের অমোঘ সত্য প্রতি সপ্তাহে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছি।
০৭. আমাদের বৈঠকের গাল্পিক কথা
আমাদের বৈঠকের গাল্পিক কথা-সাহিত্যিক বললেন–আপনার গল্পে কবি নিশিকান্তকে একবার ছুঁইয়েই ছেড়ে দিলেন। সেই ইঁদুরের মাংস খাওয়ার ঘটনাটা? সেটা তো ধামা চাপা পড়ে গেল।
আড্ডার সেই ক্ষীণকায় সব্যসাচী লেখক টিপ্পনী কেটে বললেন—ধান ভানতে শিবের গাজন। কোথায় পড়ে রইল নিশিকান্তর খাওয়ার গল্প, নিজের কথাই সাত কাহন।
হক-কথা। স্মৃতি মন্থন করে যারাই গল্প বলেন তাদের প্রধান দোষ বা মুদ্রা দোষই বলুন, অপরের কথা বলতে গিয়ে নিজের কথাকে সামনে তুলে ধরা। তবু আমি চেষ্টা করেছিলাম শৈশবে যে-পরিবেশে আমরা মানুষ হয়েছিলাম, এবং যে-পরিবেশে নিশিকান্তর সাহিত্য-সাধনার সুত্রপাত, সেই পরিবেশটি শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতে।
রঙ্গমঞ্চে অভিনয় কালে কোনও চরিত্রকে দর্শকদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে হলে পটভূমিকার পরিবেশ সৃষ্টি করে তার উপর আলো নিক্ষেপ করতে হয়। আমারও ছিল সেই একই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমার কাজ ছিল নিশিকান্তর উপর আলো নিক্ষেপ করা। কিন্তু অনবধানতাবশত নিজেই যে কখন সেই আলোর সামনে এসে গেছি তা টের পাই নি। সবিনয়ে বন্ধুদের কাছে মার্জনা চেয়ে বললাম-নিশিকান্তর কথা বলতে গেলে খানিকটা নিজের কথাই এসে, পড়বে—আমি নিরুপায়। ছেলেবেলা থেকেই নিশিকান্তর সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব। তার কবি-প্রতিভার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা শৈশবকাল থেকেই। শান্তিনিকেতন আশ্রম ছেড়ে পণ্ডিচেরীর আশ্রমের আশ্রয়ে তার চলে যাওয়ার পিছনে যে বিরাট ট্র্যাজেডী ছিল। আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তির জানবার কথা নয়।
গাল্পিক বন্ধু আমার কথাটা থামিয়ে দিয়ে বললেন–আপনার কাছে আমরা ভোজনরসিক নিশিকান্তর গল্প শুনতে চাইকবি নিশিকান্তর নয়।
আড্ডার তরুণ কবি বললেন—তা কেন। কবি নিশিকান্তর শান্তিনিকেতন ছেড়ে পণ্ডিচেরী চলে যাওয়ার রহস্যটাই আমাদের জানবার আগ্রহ বেশী। আপনি সেটাই বলুন।
দুই বন্ধুকেই থামিয়ে বললাম—দুজনের কথাই রাখতে চেষ্টা করব। ভোজনরসিক ও কাব্যরসিক—নিশিকান্ত চরিত্রের এই দুই রূপ আপাতবিরোধী মনে হলেও একটি আরেকটির পরিপূরক। নিশিকান্ত যখন আহারে বসে তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন তার কাছে বিলীন হয়ে যায়। ওর মত একাগ্রচিত্তে তদতভাবে আহার্য-বস্তুকে উপভোগ করতে আমি আর কাউকে দেখি নি। আবার যখন কবিতা রচনায় সে বসে তখনও দেখেছি তার সেই একই রূপ। স্নানাহার ভুলে কাব্যরসে এমন তন্ময় হয়ে ডুবে যাওয়া এক নিশিকান্তকেই আমি দেখেছি।
কবিতার ছন্দ, আঙ্গিক, শব্দচয়ন ও বিষয়বস্তু নিয়ে নিশিকান্ত নিত্যনিয়ত যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত তেমনি চলত তার রান্না নিয়ে নানারকমের এক্সপেরিমেন্ট। নিশিকান্ত ছিল ঘোরতর মাংসাসী।
শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সাঁওতালদের প্রায়ই দেখা যেত শীতকালে ধানকাটা হয়ে যাবার পর ধানক্ষেতে ছেলে বুড়ো সবার ইঁদুর ধরার উল্লাস। পাঁচদশটা ইঁদুর যদি ধরতে পারল তো পরব লেগে গেল। সন্ধ্যায় হাড়িয়ার সঙ্গে ইঁদুরের মাংস, তারপরে মাদল বাজিয়ে নাচ। বর্ষাকালে ছিল তাদের ধানক্ষেতের ব্যাঙ-গেলা ঢোড়াসাপ ধরবার পালা। ৪৫ হাত লম্বা একটা সাপ ধরতে পারলে সেদিন পরব চলবে সারারাত আর হাড়িয়া চলবে কলসী কলসী।
এই সব অভিজ্ঞতা থেকেই নিশিকান্তর থিয়োরী ছিল যে, সাঁওতালরাও মানুষ, আমরাও মানুষ। ওরা যা খেতে পারে আমরা তা পারব না কেন? সুতরাং পরীক্ষাটা ইঁদুরের মাংস দিয়েই প্রথম শুরু হয়ে যাক। খাওয়ার ব্যাপারে নিশিকান্তর কোনও বাছ-বিচার ছিল না। এ-বিষয়ে ও ছিল সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত। আর তা হবে না-ই বা কেন। ওর দাদা সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। সুধাকান্তদার কাহিনী শুনলে খাবার ব্যাপারে নিশিকান্তর বেপরোয়াপনা বুঝতে অসুবিধা হবে না।
শান্তিনিকেতন থেকে মাইল চারেক দূরে তালতোড় বলে এক জায়গায় একবার বাঘের উৎপাত দেখা দিল। গ্রামবাসীদের গরু-ছাগল প্রায়ই মারা পড়ছে এ-খবর আমরা রোজই পাচ্ছিলাম। একদিন বাঘের কামড়ে জখমহওয়া এক সাঁওতালকে শান্তিনিকেতনের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এনে হাজির করল। সাঁওতালটির অবস্থা দেখে উচুক্লাসের ছাত্ররা স্থির করল বাঘ মারতেই হবে। নেপালবাসী নরভূপ ছিল আশ্রমের আদ্যবিভাগের ছাত্রদের দলপতি, যেমন বিশাল তার চেহারা তেমনি বলশালী। তালতোড়ের এক পুকুর ধারে বাঘ গরু মেরে ফেলে গেছে, এই খবর পেয়ে নরভূপ কোমরে নেপালী কুকরি আর সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের ঘেয়ে কুকুর-মারার দোনলা বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে চলল বাঘ মারতে। সঙ্গে ছিল তার সমবয়সী দুঃসাহসী আটদশজন সতীর্থ। তাদের হাতে লাঠি, হকিস্টিক, বাঁশ ইত্যাদি। মাস্টার মশাইদের অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই দুপুরবেলা চলে গেল পশ্চিম প্রান্তের প্রান্তর পেরিয়ে তালতোড়ার দিকে, আমরা দূর থেকে তাদের চলে যাওয়াটাই দেখলাম। আশ্রমময় সে কী উৎকণ্ঠা।