আজ্ঞে আপনি আমার বাগানে পেয়ারা পাড়তে যাবেন সে-সৌভাগ্য কি আমার কোন দিন হবে?
এই কথা শোনার পর দীপুবাবু আর কপট গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারলেন। সহাস্যে বললেন–বাপের উপযুক্ত পুত্ৰই বটে। বয়, ছোঁড়া দুটোকে কিছু লেবেঞ্চুস দিয়ে দে।
কঙ্করদার উপস্থিত কং অর্থাৎ রসিকতার গুণে সেদিন শাস্তির বদলে লজেন্স নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আর পালিয়েছিল বলে টুনাং-এর তখন কী দুঃখ।
আগেই বলেছি, কঙ্করদা ছিলেন নানারকম বুদ্ধি বাতলানোর বাদশা আর আমরা ছিলাম তার হুকুমবরদার। কঙ্করদা স্থির করলেন গুরুপল্লীর জন্য একটা
সংবাদপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং তার নাম হবে গুরুপল্লী সমাচার। কঙ্করদার মুখ দিয়ে একটা কিছু নতুন প্ল্যান বেরলেই হয়, আমি ছিলাম এসব ব্যাপারে ঝড়ের আগে এটো পাতা।
দৈনিক সংবাদপত্রের আকারের একটা পেস্ট-বোর্ড সংগ্রহ করে ফেললাম, কিছু ফুল্যাপ সাদা কাগজও। ময়দা জাল দিয়ে লেই তৈরী করতে দেরি হল না। কঙ্করদা ছিলেন পত্রিকার একাধারে সম্পাদক, বার্তাসম্পাদক, রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা ইত্যাদি। আমার হাতের লেখা কিছুটা রাবীন্দ্রিক ধাঁচের ছিল বলে আমি ছিলাম তার মুদ্রাকর। রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর লণ্ঠন জেলে আমরা দুজনে গুরুপল্লী সমাচার প্রস্তুত করতাম এবং ভোরবেলা কাক-কোকিল ডাকবার আগেই গুরুপল্লীর সামনের একক বাঁশঝাড়টার গায়ে তা লটকে দিয়ে অসিতাম। সকাল হলে ইস্কুলে যাবার আগে বাড়ির ছোট্ট ঘরের জানলার পাল্লাটা একটু ফাঁক করে দেখতাম সংবাদপত্রের প্রচার কতখানি হল অর্থাৎ পাঠক সংখ্যা কতজন। দুঃখের বিষয় আমাদের সমবয়সী দু-চার জন পাঠক ছাড়া বিদগ্ধ পাঠকদের সে-পত্রিকা আকর্ষণ করতে পারে নি। তা না করুক। আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছিলাম।
বুধবার ছিল আমাদের ছুটি। সেদিনের সমাচারে থাকত গুরুপল্লীর বিভিন্ন মাস্টারমশাইদের নিয়ে টিপ্পনী। এক বুধবারের কাগজে সংবাদ পরিবেশিত হল :
গুরুপল্লীতে গরু বিভ্রাট
দুই গুরুর মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামার উপক্রম
[ নিজস্ব সংবাদদাতা প্রদত্ত ]
সংবাদে প্রকাশ গুরুতর কোন এক মাস্টারমশাইয়ের গৃহপালিত গরু পার্শ্ববর্তী মাস্টারমশাইয়ের রান্নাঘর সন্নিকটস্থ তরকারির ক্ষেতে অনধিকার প্রবেশ করিয়া কচি ঢাড়শ খাইয়া তছনছ করিয়াছে। ক্ষেতের মালিক প্রতিবাদ জানাইলে তুমুল বাদবিতণ্ডা শুরু হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালতে (গুরুদেবের সন্নিকটে) উপস্থাপিত হইবার পূর্বেই অনরারী ম্যাজিস্ট্রেট রায় সাহেব জগদানন্দ রায়ের মধ্যস্থতায় আপসে মিটমাট হইয়া যায়। এরূপ শোনা যাইতেছে যে, গরুর মালিক সবজিক্ষেতের মালিকের নিকট গরুর অন্যায় অপকার্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন।
পাড়ার কোন এক বকাটে ছেলে শিয়োনামা থেকে সংবাদের সর্বত্র গু স্থানে গ ও গ স্থানে গু লিখে রেখেছিল।
গুরুপল্লী সমাচারে এই ধরনের সংবাদ প্রায়ই প্রকাশিত হত, প্রায়ই তার উপর ফাজিল ছেলের দল নানাবিধ মন্তব্য লিখে রাখত। সংশ্লিষ্ট মাস্টার মশাইদের মধ্যে কেউ কেউ এতে মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও পত্রিকার সম্পাদক ও মুদ্রাকরের নাম ও পরিচয় গোপন থাকায় নীরবে টিপ্পনী হজম করতেন, প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না।
নিশিকান্ত ছিল আমাদের পত্রিকার নিয়মিত লেখক। প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই সে ব্যঙ্গ কবিতা লিখত, আমরা প্রাধান্য দিয়েই তা প্রকাশ করতাম। নিশিকান্ত একবার গ্রাম্য কবিয়ালদের ছড়ার অনুকরণে গুরুপল্লীনামা শীর্ষক একটি ছড়া লিখেছিল। সেই ছড়া সমাচারে প্রকাশিত হবার পর পত্রিকার পাঠকসংখ্যা বেড়ে গেল। পরবর্তী কালে নিশিকান্তর সেই গুরুপল্লীনামা কিছু পরিবর্তিত আকারে কবিগানের সুর সংযোগে শান্তিনিকেতন আশ্রমের বহু আসরে গীত হয়েছে।
তিন মাস ধরে প্রতিদিন গুরুপল্লী সমাচার পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে একটা সামান্য কারণেই পত্রিকার অকাল মৃত্যু ঘটল। সেদিন ছিল বুধবার। এখনকার বাংলা দেশের সেরা পত্রিকাগুলির ছুটির দিনের খোরাক যোগাবার জন্যে রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। সমাচারের ছিল বুধবাসরীয় ক্রোড়পত্র, তাতে থাকত গুরুপল্লীর বালখিল্যদের নানাবিধ রচনা : গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী। মঙ্গলবার সারারাত আমার কেটে গেল পত্রিকা ছাপাতে অর্থাৎ লেখাগুলি শ্রীঅক্ষরে কপি করতে। ভোরে যথারীতি বাঁশঝাড়ে লটকে দিয়েই বাড়ি এসে টেনে এক ঘুম।
বেলা দশটা নাগাদ করদা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললেন
এই শিগগির ওঠ। এক কাণ্ড হয়েছে। গোঁসাইজী আমাদের পত্রিকার উপর কী সব মন্তব্য লিখেছেন।
ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়েই ছুটলাম বাঁশঝাড়ের দিকে। গোঁসাইজী মন্তব্য লিখেছেন? গোঁসাইজী আমাদের পাড়ারই বাসিন্দা। আমরা ইস্কুলে তাঁর কাছে বাংলা পড়তাম, পরবর্তী জীবনে কলেজে উঠে পড়েছি বৈষ্ণব সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সেদিনও আমাদের শ্রদ্ধা ছিল, আজও আছে। গোঁসাইজী মন্তব্য লিখেছেন, আর আমাদের পায় কে!
বাঁশঝাড়ে গিয়ে দেখি গুরুপল্লী সমাচার লাল পেন্সিলের দাগে ক্ষতবিক্ষত। বত্রিশটা ভুল বানান আর পনেরটা শব্দের অপপ্রয়োগের উপর লাল পেন্সিলের ট্যাড়া মেরে পত্রিকার এক-কোনায় মন্তব্য লেখা আছে—
মুদ্রাদোষে পত্রিকাটি কণ্টকাকীর্ণ। যে-বালক ইহা নকল করিয়াছে তাহার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাংলা পরীক্ষায় তাহার উত্তীর্ণ হইবার কোন সম্ভাবনাই দেখিতেছি না। মন্তব্যের নিচে স্পষ্টাক্ষরে স্বাক্ষর আছে শ্রীনিতাইবিনোদ গোস্বামী।