কঙ্করদা বয়সে ছিলেন আমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড়, বুদ্ধিতেও তুখোড়। আমরা, পাড়ার ছেলেরা একবাক্যে তাঁকে দলপতি মেনে নিয়েছিলাম।
আমাদের পাড়াটা ছিল শান্তিনিকেতনের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে। মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া এক সারিতে আট-দশ ঘর। পাড়ার নাম গুরুপল্লী। বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষকরা সপরিবারে এই পল্লীতে থাকতেন। এই পল্লীর প্রতিবাসীদের মধ্যে ছিল আত্মীয়তার নিবিড় ও মধুর সম্পর্ক। পাড়ার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠরা ছিলেন দাদা ও দিদির মত, কনিষ্ঠেরা ছিল ছোট ভাইবোন। এই সম্পর্কের মধ্যে কখনও আপন-পর ভেদ ছিল না।
কঙ্করদা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার অনেক কিছুই পেয়েছেন। পাণ্ডিত্যের কথা অবশ্য আমি বলতে পারব না, তবে পৈত্রিক বিশেষ যে গুণটি তিনি পেয়েছেন তা হচ্ছে তার অপূর্ব রসিকতা।
একবার শান্তিনিকেতনের এক পারসী অধ্যাপক মিস্টার মরিস কঙ্করদাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন
তোমার বাবা সংস্কৃতে বিরাট পণ্ডিত, কিন্তু তোমার নাম কঙ্কর রাখলেন কেন?
কঙ্করদা তৎক্ষণাৎ বললেন–কেন? এও তো সংস্কৃত শব্দ। কং করোতি যঃ সঃ ইতি কঙ্কর।
মরিস সাহেব অবাক হয়ে বললেন– তোমার নামের এমন একটা সংস্কৃত অর্থ আছে তা তো জানতাম না। কিন্তু কং কথার মানেটা কি!
কং অর্থাৎ রসিকতা। এটা পালি শব্দ, হীনযান বা মহাযান-এ পাবেন না, চীনযান-এ আছে। এই বলেই কঙ্করদা মরিস সাহেবের সামনে থেকে দে-চম্পট, পাছে আবার চীনযানটা কী জিজ্ঞাসা করে বসেন।
কঙ্করদার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে একবার আমরা বাঘের মুখ থেকে বেঁচে এসেছি। সে-ঘটনা বলি : শান্তিনিকেতনের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে আম-কাঠাল লিচু-পেয়ারা ও নানাবিধ দেশী ফল ও ফুলের বাগান পরিবৃত একটি বাড়ির পূর্ব অংশে থাকতেন রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ওই বাড়িরই পশ্চিম অংশে থাকতেন দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বীপেন্দ্রনাথ। বাড়িটার নাম নীচুবাংলা। দ্বীপেন্দ্রনাথকে আশ্রমবাসী সকলেই দীপবাবু বলে ডাকতেন। তাঁর উপর তখন ছিল আমপরিচালনার ভার। রাসকারী মানুষ, কিন্তু তার অরটি ছিল সমুদ্রের মতই বিরাট।
বর্ষাকালের এক দুপুরে কঙ্করদা এসে খবর দিলেন, নীচুবাংলার বাগানে প্রচুর পেয়ারা হয়েছে। কঙ্করদা এমনিভাবে প্রায়ই আমাদের বুদ্ধি যোগান, আমরা তার অনুরক্ত সেনানী, সর্বদাই আদেশ পালনের জন্য পা বাড়িয়েই আছি।
ঠিক হল দুপুরে সবাই যখন দিবানিদ্রায় মগ্ন সেই সময় পেয়ারা পাড়তে হবে। কঙ্করদা বললেন—না রে, দীপুবাবু আজকাল পাহারা দেবার জন্য গাছতলায় লোক বসিয়ে রাখেন। তার চেয়ে শেষরাত্রে টর্চের আলো নিয়ে পেয়ারা পাড়াই সমীচীন।
নিশিকান্ত বললে—রাত্রে শুনেছি একটা নেপালী দারোয়ান বন্দুক নিয়ে পাহারা দেয়, এতে আমি নেই।
ডানপিটে বর্মী টুনাং বললে—কুছ পরোয়া নেই। দুপুরেই পেয়ারা পাড়ব। আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। তোমরা শুধু দূর থেকে নজর রেখে পাহারাদার লোকটা কোনদিকে থাকে। বিপদ বুঝলেই ইশারা করবে, আমি গাছ থেকে এক লাফে নেমে ছুট লাগাব।
স্থির হল কঙ্করদা দূর থেকে ইশারা করবেন, টুনাং গাছে চড়বে, আমি তলায় দাঁড়িয়ে পেয়ারা কুড়ব।
পরিকল্পনা যখন প্রস্তুত তৎক্ষণাৎ তা কাজে পরিণত করা চাই। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা নীচুবাংলার বাগানে ঢুকেছি। টুনাং চক্ষের নিমেষে মগডালে উঠে জল-ভেজা পেয়ারা ধপাধপ ফেলছে আর আমি তা কুড়তে ব্যস্ত।
হঠাৎ ভারিক্কী গলার বাজখাঁই আওয়াজ উঠল—
বয়, ছোঁড়াগুলোকে ধরে আন তো।
বয় ছিল দীপুবাবুর চব্বিশ ঘণ্টার অনুরক্ত ভৃত্য। ভৃত্য বললে তাকে ছোট করা হয়। সে ছিল দীপুবাবুর ফ্রেণ্ড, ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড। বালক বয়সেই সে দীপুবাবুর ভৃত্যরাজতন্ত্রে উজির-নাজির হয়ে ঢুকেছিল, যৌবনে সে হয়েছিল একচ্ছত্র সম্রাট। বালক বয়সে বয় নামেই সে সকলের পরিচিত, তার পৈত্রিক নাম শান্তিনিকেতনিকরা কেউ কখনও জানতেন না।
চক্ষের নিমেষে টুনাং টার্জনের মত এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঝুলতে বুলতে লাফ মেরে মাটিতে পড়েই টেনে দৌড়। আমি তখনও পেয়ারা পকেটস্থ করতে ব্যস্ত, কখন যে মালী আর চাকর মিলে জন-চারেক লোক এসে ঘিরে ফেলেছে টেরই পাই নি। বমাল ধরা পড়লাম! তাকিয়ে দেখি কঙ্করদা আমার আগেই ধরা পড়েছেন, টুনাং ততক্ষণে পগার পার। আমাদের দুজনকে হাজির করা হল দীপুবাবুর সামনে। দীপুবাবুকে আমরা বাঘের মত ভয় করতাম। আর পড়বি তো পড় সেই বাঘের মুখেই। দীপুবাবুর দুই প্রিয়পাত্রের আমরা দুই পুত্র। বয়ঃজ্যেষ্ঠ কঙ্করদা, সুতরাং তাকেই উদ্দেশ করে দীপুবাবু মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন–
পেয়ারা পাড়ার অনুমতি নিয়েছিলে?
আজ্ঞে না।
কটা পেয়ারা পেরেছ?
সঙ্গে সঙ্গে হাফ প্যান্ট আর জামার পকেটে যে-কটা পেয়ারা ছিল বার করে সামনে রাখলাম।
দীপুবাবু পেয়ারাগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু বেদনাহত কণ্ঠে বললেন— ঈ, এই সব কচি-কচি পেয়ারাগুলো পেড়ে নষ্ট করলে? বড় হলে তো তোমরাই খেতে, আর দু-চারটে দিন অপেক্ষা করতে পারলে না?
এইটুকু বলেই কঙ্করদার দিকে তাকিয়ে বললেন–
আচ্ছা কঙ্কর, তুমিই বল। আমি যদি তোমার বাগানে গিয়ে এইভাবে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে কচি পেয়ারা পেড়ে তছনছ করতাম, তোমার মনে কি দুঃখ হত না?
কঙ্করদা সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটা অমায়িক হাসি এনে হাত কচলাতে কচলাতে সলজ্জ স্বরে বললেন–